অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে দেশের ৮৪% শ্রমিক, নেই রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা

প্রতিবেদক: দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত, যাদের জন্য রাষ্ট্র কোনো দায়িত্ব নেয় না। শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই, আইনি সুরক্ষা নেই, কর্মস্থলের পরিচয়পত্র পর্যন্ত নেই। এমনকি কোনো অন্যায়ের শিকার হলেও শ্রম আদালতে যাওয়ার সুযোগ নেই তাদের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এমন শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।

এই বাস্তবতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। কমিশন গত ২১ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ২৫ দফা সুপারিশ পেশ করেছে, যার প্রথমেই রয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিকসহ সব খাতের শ্রমিককে আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব। ১৯ সদস্যের এই কমিশনের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ।

সুলতান উদ্দিন আহমেদ জানান, অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের শ্রম আইনের আওতায় আনতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, সামাজিক নিরাপত্তা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার মহান মে দিবসে এই বাস্তবতায় দিবসটি পালন করা হচ্ছে। যদিও এটি সরকারি ছুটির দিন, তবুও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কাজ করতে হবে। ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’—এবারের প্রতিপাদ্য। দিবসটি ঘিরে নানা উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

বিবিএসের নভেম্বর ২০২৩-এর জরিপ অনুযায়ী, দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার, এর মধ্যে ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শ্রমশক্তি। মোট শ্রমশক্তির ৮৪.১ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। আইএলওর মান অনুযায়ী, সপ্তাহে অন্তত ১ ঘণ্টা পারিশ্রমিক বা পারিবারিক ভোগের জন্য কাজ করলেই তাকে কর্মে নিয়োজিত ধরা হয়। দেশে বেকারের সংখ্যা বর্তমানে ২৪ লাখ ৬০ হাজার।

আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, আইনি স্বীকৃতিহীন, হিসাববিহীন, বেসরকারি ও অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন খাতগুলো অপ্রাতিষ্ঠানিক। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে এই শ্রমিকদের আধিক্য বেশি। কৃষিতে ৯৮.৬৩ শতাংশ, শিল্পে ৮২.৭৫ শতাংশ এবং গ্রামে মোট শ্রমিকের ৮৭.৪ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। শহরে এ হার ৭৪.৫ শতাংশ। নারী শ্রমিকদের মধ্যে ৯৫.৭ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী ও স্বনিয়োজিত শ্রমিকদের শ্রম আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের কাজের স্বীকৃতি, নিরবচ্ছিন্ন কাজ ও আয়ের নিশ্চয়তা এবং শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার সুপারিশ রয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তরে পৃথক ডেস্ক স্থাপন, তথ্যভান্ডার তৈরি ও অবসর ভাতা চালুর কথাও বলা হয়েছে।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা অবসরের পর কোনো ধরনের সুবিধা পান না। এ কারণে কমিশন ৬০ বছর বয়সসীমা নির্ধারণ করে প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ করেছে। তাদের খাদ্য, চিকিৎসা, বস্ত্রসহ মৌলিক চাহিদার ভিত্তিতে ভাতার পরিমাণ নির্ধারণের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের তুলনায় কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও সমস্যা কম নয়। এখনো ৫৫টি শিল্পখাত ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর বাইরে। টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে সর্বশেষ মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। বর্তমান মজুরি বোর্ডের আওতায় রয়েছে ৪৭টি শিল্প। আরও ২০টি শিল্প খাতকে আওতায় আনতে কাজ চলছে। তবে পেট্রোল পাম্পের মতো কিছু খাতে মালিকপক্ষের অনীহার কারণে বোর্ড কার্যকর করা যাচ্ছে না।

মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম জানিয়েছেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্প এখন বিলুপ্তপ্রায়, তাই হয়তো খাতটি বাতিল করা হবে। তবে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে—এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।