
প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। চারটি বড় ধরনের পিছিয়ে থাকা খাত হলো—রাজস্ব আয়ের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি না হওয়া, বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক না হওয়া, ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে অগ্রগতি না থাকা এবং ব্যাংক খাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হওয়া।
দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ সফরের পর গত বৃহস্পতিবার আইএমএফের প্রতিনিধিদল এক ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য তুলে ধরে। যদিও চূড়ান্তভাবে তারা কিস্তি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত দেয়নি, তবে জানিয়েছে—সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী জুনের শেষ দিকে কিস্তির অর্থ ছাড় হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন আইএমএফের গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওসহ ৯ সদস্যের একটি দল। এর আগে তারা ৬ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ৩.৩ শতাংশ, যেখানে গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ৫.১ শতাংশ। জনগণের আন্দোলন, কঠোর মুদ্রানীতি ও বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তবে মূল্যস্ফীতির হার ১১.৭ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৯.৪ শতাংশে, যদিও এটি এখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫–৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
আইএমএফ জানায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বিনিময় হার মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও, বিনিময় হার আরও নমনীয় হলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বাড়বে। সংস্থাটি একটি বিবৃতিতেও এ বিষয়ে মতামত তুলে ধরে।
আইএমএফ বলছে, জিডিপির তুলনায় কর আহরণের হার এখনও অনেক কম। করনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করা, কর ছাড় কমানো এবং রাজস্ব বৃদ্ধির টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানায় সংস্থাটি। এর পাশাপাশি সরকার যেন সামাজিক খাত ও অবকাঠামোয় অর্থ ব্যয় করতে পারে, সেজন্য একটি সমন্বিত রাজস্ব কৌশলপত্র প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে।
ব্যাংক খাতের উন্নয়নে আইএমএফ জোর দিয়েছে আইনগত সংস্কার, কার্যকর সম্পদ মান যাচাই, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সুশাসন নিশ্চিত করার ওপর। একই সঙ্গে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধ, খেলাপি ঋণ কমানো, দুর্বল তদারকি ও নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতার অভাব দূর করার সুপারিশও এসেছে।
ব্রিফিংয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে পাপাজর্জিও বলেন, শুধু পরিকল্পনা নয়, বাস্তবায়নে স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতা গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা এবং অবকাঠামো খাতে টেকসই বিনিয়োগ নিশ্চিত করাও জরুরি বলে জানান তিনি।
আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। প্রথম কিস্তি (৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার) পেয়েছিল বাংলাদেশ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর দ্বিতীয় কিস্তি (৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার) আসে ডিসেম্বরে এবং তৃতীয় কিস্তি (১১৫ কোটি ডলার) পাওয়া যায় ২০২৪ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত মোট ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে আরও ২৩৯ কোটি ডলার।
অর্থনীতিবিদদের মতে, আইএমএফের ঋণ শুধু টাকার জন্য নয়, বরং এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আস্থা তৈরি হয়। যদি এই ঋণ না আসে, তাহলে অন্য উন্নয়ন অংশীদাররাও নিরুৎসাহিত হতে পারে এবং বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমে যেতে পারে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “আইএমএফের পর্ষদে যেতে হলে ১০০ শতাংশ শর্ত পূরণ থাকতে হয়, ৭৫ শতাংশ থাকলেও চলবে না।” তবে তিনি মনে করেন, কিস্তি পুরোপুরি আটকে যাবে না। ব্যাংক খাতের কিছু উন্নতিতে সংস্থাটি সন্তুষ্ট। আগামী মে মাসে আইএমএফের আরেকটি দল বাংলাদেশ সফরে আসবে। তখন হয়তো কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে ইতিবাচক বার্তা আসতে পারে।