আগস্টে শুরু হচ্ছে ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্সের আবেদন গ্রহণ: বাংলাদেশ ব্যাংক

প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী আগস্ট মাস থেকে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানের জন্য নতুন করে আবেদন গ্রহণ শুরু করতে যাচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ২০২৩ সালে যারা ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল, তারাও এই প্রক্রিয়ায় আবার আবেদন করতে পারবে।

গভর্নর মনসুর বলেন, “আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে দ্রুতই বাছাই প্রক্রিয়ায় যাওয়া হবে।” তিনি স্পষ্টভাবে সংখ্যা উল্লেখ না করলেও জানান, চূড়ান্ত অনুমোদনের সংখ্যা নির্ভর করবে আবেদনকারীদের গুণগত মানের ওপর। তাঁর ভাষ্য, “খুব বেশি লাইসেন্স দেওয়া হবে না, আমরা ধাপে ধাপে এগোবো।”

তিনি আরও বলেন, সম্ভাব্য ডিজিটাল ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের কমপক্ষে ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ সক্ষমতা থাকতে হবে। পাশাপাশি থাকতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ধৈর্য। উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান, বিকাশকে লাভে যেতে ১২ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, নগদকেও হয়তো ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

ক্ষুদ্র ঋণ (ন্যানো লোন) বিষয়ে গভর্নর জানান, বর্তমানে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ন্যানো লোন দিতে পারবে না। এর জন্য তাদের ডিজিটাল ব্যাংক সাবসিডিয়ারি গঠন করতে হবে অথবা আলাদা লাইসেন্স নিতে হবে। বর্তমানে এমএফএসের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া যাচ্ছে, ভবিষ্যতে তা বাড়িয়ে ১ লাখ, দেড় লাখ বা ৫ লাখ পর্যন্ত করা হতে পারে—তবে এর জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ সক্ষমতা থাকতে হবে।

২০২৩ সালের ১৪ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের গাইডলাইন’ প্রকাশ করে এবং ২১ জুন থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ করে। সে সময় ৫২টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে আটটি প্রাথমিক অনুমোদন পায় এবং দুটি ব্যাংক ‘লেটার অব কনসেন্ট’ (এলওসি) লাভ করে।

তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান স্থগিত করে দেয়। এরপর নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আহসান এইচ মনসুর পুরো লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া পর্যালোচনার ঘোষণা দেন।

২০২৩ সালের অক্টোবরে ‘লেটার অব ইনটেন্ট’ (এলওআই) পাওয়া কড়ি ডিজিটাল ব্যাংক চূড়ান্ত লাইসেন্স পেতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাগজপত্র জমা দিতে ব্যর্থ হয়। তবে কড়ি ডিজিটালের অন্যতম উদ্যোক্তা আনিস এ খান জানান, তারা পরবর্তীতে সব প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও ফি বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছেন এবং এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, ২০০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে ৭২ কোটি টাকা প্রযুক্তি সহায়তা হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগ থেকে আসবে, যার অনুমোদন বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে দিয়েছে।

ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক। ২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ: কান্ট্রি প্রাইভেট সেক্টর ডায়াগনস্টিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তারা অভিযোগ করে, আবেদন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং পক্ষপাতিত্ব ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫২ আবেদনকারীর মধ্য থেকে কেবল ‘নগদ’ ও ‘কড়ি’কে লাইসেন্স প্রদান করা হয়, যা পক্ষপাতের ইঙ্গিত দেয়।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার অস্পষ্ট নীতিমালার কারণে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ‘চুক্তি ও লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকলে উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয় না’, প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বিশ্বব্যাংকের দুটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান—ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন  ও মাল্টিল্যাটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি । ২০২৫ সালের এপ্রিলে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট’-এ এই প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, কিছু আবেদনকারীকে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত লাইসেন্স দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, অন্যদের অস্পষ্ট “ডিজিটাল ব্যাংকিং উইন্ডো”-র সুযোগ দেওয়া হয়েছে—যা প্রক্রিয়ার স্বেচ্ছাচারিতার ইঙ্গিত দেয়।