
প্রতিবেদক: বাজেট ঘাটতি মেটাতে আসন্ন ২০২৫–২৬ অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে কম ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরে সরকারের মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। একই অনুপাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। তবে ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আড়াই লাখ কোটি টাকার নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছে। এই ঋণ দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
প্রতি অর্থবছরে বাজেট–ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশের আশপাশে রাখা হয়। তবে আগামী অর্থবছরে বাজেট–ঘাটতি ৪ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও ঘাটতি পূরণে অধিকাংশ ঋণই আসবে দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকেই।
চলতি অর্থবছরে নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য ছিল ব্যাংক খাত থেকে, বাকিটা সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে। আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ১৫ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হচ্ছে। বাকি ১ লাখ ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ হবে দেশি উৎস থেকে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নেয়া হতে পারে।
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট দেশি ও বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার ২৮২ কোটি টাকায়। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৮ লাখ ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ গত চার বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
দেশি–বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়ায় ঋণের সুদ পরিশোধে আগামী বাজেটে এক লাখ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে, যার বড় অংশ ব্যয় হবে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদে। সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রধান সমস্যা রাজস্ব আদায়ে। রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সরকারের এত ঋণ নিতে হতো না। সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় আগামী বছর সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকেই ভালো আয় করতে পারবে।’
বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে দুটি উপায়ে ঋণ নেয়—একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে, অন্যটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়, আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। গত এপ্রিল মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা উদ্বেগজনক। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকঋণ মূল্যস্ফীতির একটি কারণ হলেও সরকারের সামনে বিকল্প খুব সীমিত।
চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, তবে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এ বছরের আট মাসে সরকার ব্যাংক খাত থেকে মাত্র ১৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং ব্যাংকঋণের সুদ দিতে বিপুল রাজস্ব ব্যয় করতে হয়। রাজস্ব আদায় বাড়ানো ছাড়া এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাজেট যদি ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটির মধ্যে থাকে, তবে তা মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় ছোটই বলা চলে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হলে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম, যার কারণে সরকারকে বারবার ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।’