আদানির চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা ও সমালোচনা বাড়ছে

অনলাইন ডেক্স: ভারতীয় ধনকুবের আদানি গ্রুপের চেয়ারপারসন গৌতম আদানি ও তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে গত বছরের নভেম্বরে ঘুষ ও প্রতারণার অভিযোগ তোলে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ফেডারেল কৌঁসুলিরা। এর পর থেকেই বিভিন্ন দেশে ব্যবসা পরিচালনায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গ্রুপটি।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বন্ড বিক্রির পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয় আদানি গ্রুপ। কেনিয়ায় বিমানবন্দর ও বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণের চুক্তি বাতিল হয়, আর শ্রীলংকায় আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। তবে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। এখনো আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত বিতর্কিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি বাতিল বা সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর জন্য আদানিকে অনুরোধ করেছে সরকার। এই অবস্থানকে অনেকে সরকারের নতজানু নীতি বলে মনে করছেন।

সরকারের পক্ষ থেকে এই চুক্তির বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ভারত সফরে গেছেন। সেখানে তিনি এনার্জি উইক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন, তবে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে কোনো আলোচনার সম্ভাবনা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

ডলার সংকটের কারণে বকেয়া বিল জমে যাওয়ায় গত বছরের ৩১ অক্টোবর আদানি গ্রুপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ করে দেয়, ফলে গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সরবরাহ অর্ধেকে নেমে আসে। শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও একটি ইউনিট থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে বলা হয়েছিল। তবে আসন্ন গ্রীষ্মকালের চাহিদা মেটাতে সরকার আবার আদানিকে সম্পূর্ণ সক্ষমতা অনুযায়ী (১,৬০০ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ সরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছে বলে রয়টার্স জানিয়েছে।

ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় ১,৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি সই করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলারে নির্মিত এই কেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রথম ইউনিট থেকে এবং জুনে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে। রয়টার্সের হিসাব অনুযায়ী, ভারতে আমদানীকৃত বিদ্যুতের গড় দামের চেয়ে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ ৫৫ শতাংশ বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে চালু হওয়ার পর থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত আদানি পাওয়ারের কাছ থেকে ১৪,৩৮৮ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২০২৩ সালের এপ্রিল-জুন সময়ে কেনা হয় ২,২৪১ কোটি টাকার বিদ্যুৎ, আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ক্রয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২,১৪৭ কোটি টাকায়।

২০২৩ সালের জুন শেষে আদানি পাওয়ারের কাছে বিপিডিবির বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৬,৩৯০ কোটি টাকা, যা পরবর্তী মাসগুলোতে আরও বেড়ে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে আদানি পাওয়ারের কাছে বিপিডিবির মোট পাওনা দাঁড়িয়েছে ৭৭ কোটি ডলার। অন্তর্বর্তী সরকার গত পাঁচ মাস ধরে প্রতি মাসে গড়ে ৮.৫ কোটি ডলার পরিশোধ করছে, যা ক্রয়কৃত বিদ্যুতের পরিমাণের তুলনায় বেশি। মূলত বকেয়া কমানোর লক্ষ্যে সরকার এই নীতি অনুসরণ করছে, ফলে আদানি গ্রুপও কিছুটা সন্তুষ্ট বলে জানা গেছে।

আদানির সঙ্গে বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে শুরু থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্যের দিক থেকে এই চুক্তি অসম। গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ খাতের অসম চুক্তিগুলো পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়, যার অংশ হিসেবে আদালতের নির্দেশে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এ মাসের মধ্যেই ওই কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ হতে পারে, যা আদানির চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, “আদানির সঙ্গে দেনা-পাওনা নিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল, যা এখন নিষ্পত্তি হয়েছে। পাওনা পরিশোধ রাতারাতি সম্ভব নয়, তবে আমরা ধাপে ধাপে অর্থ পরিশোধ করে যাচ্ছি। শীতের কারণে এতদিন শুধু একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছিল, তবে এখন চাহিদা বাড়ায় আরেকটি ইউনিট থেকেও বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বলা হয়েছে। তবে উচ্চ কম্পন ও কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে ইউনিটটিতে উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হয়নি।”

আদানির সঙ্গে কয়লার দামসহ বেশ কয়েকটি অনিষ্পন্ন ইস্যু এবং বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির অস্বচ্ছতা নিয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, “আমাদের বাজারে কয়লার দাম এক রকম, অথচ আদানির পক্ষ থেকে ভিন্ন দাম দাবি করা হচ্ছে। আমরা এক রকম অর্থ পরিশোধ করছি, কিন্তু তাদের দাবির সঙ্গে সেটি মিলছে না। এমন কিছু ধারাবাহিক ইস্যু রয়ে গেছে, যা আমরা পর্যায়ক্রমে নিষ্পত্তি করব।”

তিনি আরও জানান, বিপিডিবি ও আদানির আলাদা দুটি কমিটি রয়েছে, এবং এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। চুক্তির অনিষ্পন্ন বিষয়গুলোর সমাধানে দুই পক্ষই কাজ করছে এবং একসময় সব ইস্যু নিষ্পত্তি হবে। যেহেতু বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আদানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, তাই তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ চাওয়া হয়েছে। তবে, সরকার কমিটির পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে কোনো নির্দেশনা দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগ পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই চলবে।

সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে গৌতম আদানি, তার ভ্রাতুষ্পুত্র সাগর আদানি ও আদানি গ্রিন এনার্জির সাবেক প্রধান নির্বাহী বিনীত জৈনসহ আটজনকে ঘুস ও প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে ব্যবসায়িকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আদানি গ্রুপ।

যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বন্ড বিক্রির পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে।কেনিয়া সরকার ৮৫.৭৪ বিলিয়ন ডলারের বিমানবন্দর ও বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ চুক্তি বাতিল করেছে।শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভা ৪৮৪ মেগাওয়াটের বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের ট্যারিফ পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও আদানির সঙ্গে করা বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিলের দাবি জোরালো হচ্ছে। তবে, এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো কঠোর অবস্থান দেখা যায়নি।

গত ২৪ নভেম্বর, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে স্বাক্ষরিত বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করতে একটি স্বনামধন্য আইন ও তদন্তকারী সংস্থাকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে। পর্যালোচনার তালিকায় আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “আদানির সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল বা সংশোধনের জন্য সরকারের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। বর্তমানে আদানির ওপর বৈশ্বিক চাপ থাকায় এটি সরকারের পক্ষে কাজে লাগানোর সুযোগ ছিল। তবে সরকার সেই দিক থেকে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না, বরং আত্মসমর্পণ করছে বলেই মনে হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক চাপ, জনমত ও সরকারের নিজস্ব প্রতিশ্রুতি সবই আদানির চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের পক্ষে ছিল। কিন্তু এসব উপেক্ষা করা খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি করবে এবং বাংলাদেশ একটি বড় সুযোগ হারাবে।

 

 

সুত্র:বনিক বার্তা