
প্রতিবেদক: চাল উৎপাদনের ঘাটতি পূরণে সরকার বেসরকারি খাতে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। আমদানিকে উৎসাহিত করতে সব ধরনের শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করা হয় এবং চার দফায় সময়সীমাও বাড়ানো হয়। তবে এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা অনুমোদিত পরিমাণ চালের মাত্র ৩২ শতাংশ আমদানি করেছেন। ফলে আমদানির ৬৮ শতাংশ চাল বাজারে আসেনি।
চাল আমদানির সময়সীমা শেষ হওয়ার পর আবারও বাজারে মোটা চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম ২ শতাংশ বেড়ে ৫০–৫৫ টাকা থেকে ৫০–৫৭ টাকায় উন্নীত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ ৩১ মার্চের এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০২৫ সালে চালের দাম রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। মে মাসে বোরো ফসল বাজারে এলে দাম কিছুটা কমতে পারে, তবে আগস্টের পর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আবারও দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসান জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীরা অনুমতি পেয়েও খুব বেশি চাল আমদানি করেননি, এটা সত্য। তবে সরকারি ও বেসরকারি খাতে যে পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে, তা বাজারে আতঙ্ক দূর করতে সহায়ক হয়েছে। ফলে মোটা ও মাঝারি চালের দামে এখন কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বরে চার দফায় ২৭৭টি বরাদ্দপত্রে ১৪ লাখ ৮১ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়সীমা ছিল ১০ থেকে ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে। এই সময়ে মাত্র এক লাখ টন চাল আমদানি হয়, যা অনুমতির মাত্র ৭ শতাংশ। এরপর আরও দুই দফায় ৫৭টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় দুই লাখ টনের অনুমতি দেওয়া হয় এবং সময়সীমাও চার দফা বাড়িয়ে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। সব মিলিয়ে ৩৩৪টি বরাদ্দপত্রে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে ১৯০টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ৫ লাখ ৪০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে। চাল আমদানিতে আগে শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, অগ্রিম আয়কর ও আগাম কর মিলিয়ে মোট ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ কর প্রযোজ্য ছিল, যা তিন ধাপে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। তারপরও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আমদানির আগ্রহ বাড়েনি।
চট্টগ্রামের আফসানা ট্রেডিংয়ের কর্ণধার ওমর আজম বলেন, সামনে বোরো মৌসুমের ফসল বাজারে আসবে। এখন আমদানি করে লাভ হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল, তাই আমদানি পুরোটা হয়নি। তবে চালের সংকট নেই এবং মধ্যস্বত্বভোগীরাও ধানের দাম বাড়িয়ে লাভ করতে পারেননি।
আরেকটি বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠান মক্কা ট্রেডার্স ১১ হাজার টনের মধ্যে ১০ হাজার ৯১৭ টন চাল আমদানি করেছে। তাদের কর্ণধার মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, যেসব প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় চ্যানেল ছিল, তারাই চাল আমদানি করেছে এবং তা নামমাত্র লাভে বিক্রি করেছে। নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো তেমনভাবে সক্রিয় হতে পারেনি।
সরকারি খাতেও চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে দেশে বছরে ৩ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন চালের চাহিদা রয়েছে। গত আগস্টে বন্যার কারণে উৎপাদন কমার আশঙ্কায় সরকার সাড়ে ৯ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি খাতে ৬ লাখ ৩৮ হাজার টন চাল খালাস হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সরকারি গুদামে ৯ লাখ ২৭ হাজার টন চাল মজুত রয়েছে এবং পাইপলাইনে থাকা চাল এলে তা ১০ লাখ টনের কাছাকাছি পৌঁছাবে।
সচিব মাসুদুল হাসান বলেন, সরকারি মজুত এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে নয়। বরং বোরো মৌসুম শুরু হলে সরকারি সংগ্রহ আরও বাড়বে, ফলে বাজারে স্থিতিশীলতা থাকবে বলে আশা করা যায়।
এদিকে গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, দেশের প্রতিদিনের চালের চাহিদা এক লাখ টন। তাই সরবরাহ যদি স্বাভাবিক না থাকে, তাহলে বাজারে চালের দাম আরও বাড়তে পারে। তিনি বলেন, বোরো মৌসুমের চাল বাজারে আসার আগপর্যন্ত আমদানির সময়সীমা বাড়ানো দরকার ছিল। তবে একই সঙ্গে কৃষকেরা যেন ন্যায্য মূল্য পান, সেদিকেও নজর দিতে হবে।