
প্রতিবেদক: রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদন ও গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রপ্তানি সত্ত্বেও চলতি মৌসুমে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন দেশের অধিকাংশ আলু চাষি। বাজারে দাম এতটাই কম যে উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত আলু রপ্তানি হয়েছে ৪৮ হাজার ১৭৭ টন। আগের অর্থবছরে তা ছিল মাত্র ১২ হাজার ১১২ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩২ হাজার ৩৯২ টন।
তবে সরকারের ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানায়, ঢাকায় প্রতি কেজি আলু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৮ থেকে ২৫ টাকায়, যেখানে গত বছর এই সময়ে ছিল ৫০-৫৫ টাকা। গত এক সপ্তাহেই দাম কমেছে ৪.৪৪ শতাংশ।
গত মৌসুমে উচ্চ দামের কারণে এবার অধিক মুনাফার আশায় চাষিরা আলু চাষ বাড়িয়ে দেন। চলতি মৌসুমে রেকর্ড পাঁচ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। এর ফলে এক কোটি ২৯ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে, যা দেশের বার্ষিক চাহিদা (৯০ লাখ টন) ছাড়িয়ে গেছে।
চাষিদের প্রধান অভিযোগ—পর্যাপ্ত হিমাগার সুবিধার অভাবে তারা উৎপাদিত আলু সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারছেন না, ফলে বাধ্য হয়ে উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে বিক্রি করছেন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি মৌসুমে গড় উৎপাদন খরচ প্রতি কেজিতে ১৪ টাকা। উত্তরাঞ্চলে তা প্রায় ২০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। অথচ বিভিন্ন জেলায় চাষিরা মাত্র ১০-১১ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছেন।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কৃষক নজরুল ইসলাম জানান, ২৩ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে প্রতি কেজি ১৮ টাকা খরচ হলেও এখন ৮-১০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। হিমাগারে জায়গার অভাবে ১ হাজার বস্তার জায়গায় তিনি রাখতে পেরেছেন মাত্র ৩০০ বস্তা।
একই এলাকার কৃষক নির্মল চন্দ্র ১৮০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন, কিন্তু ১০ হাজার বস্তা সংরক্ষণের ইচ্ছা থাকলেও রাখতে পেরেছেন মাত্র ১ হাজার ৭০০ বস্তা।
দিনাজপুরের মতিউর রহমান, মুন্সীগঞ্জের আশরাফ সরকারসহ অন্যান্য চাষিরাও একই সমস্যার মুখে। আশরাফ সরকার জানান, প্রতি কেজিতে ২৫ টাকা খরচ হলেও বিক্রি না হওয়ায় হিমাগারে রাখতে হচ্ছে, যেখানে খরচ বেড়ে দাঁড়াবে ৩২ টাকা। এতেও তিনি খরচের অর্ধেক তুলতে পারবেন না।
কারওয়ান বাজারের পাইকার মোহাম্মদ কাইয়ুম জানান, সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রতি কেজি আলুর পাইকারি দাম ১২-১৩ টাকায় নেমে এসেছে। অথচ কিছুদিন আগেও তা ছিল ১৫-১৬ টাকা।
মুন্সীরহাটের পাইকার পাপ্পু সাহা জানান, চাষিরা দোকানে আলু রেখে যাচ্ছেন, কিন্তু চাহিদা কমে যাওয়ায় বিক্রি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জানান, দেশে ৩৬৫টি হিমাগারে এখন পর্যন্ত ৩৫ লাখ টন আলু মজুদ করা হয়েছে। তারপরও একটি বড় অংশ চেইনে উদ্বৃত্ত রয়ে গেছে এবং সংরক্ষণের অভাবে বহু আলু পচে যাচ্ছে।
তার মতে, দেশের প্রকৃত আলু চাহিদা সম্পর্কে সরকারের কাছে সঠিক তথ্য নেই, ফলে উৎপাদন ও চাহিদার ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। এর ফলে চাষিরা ভরা মৌসুমেই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
কৃষি কর্মকর্তারা সনাতন পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণের পরামর্শ দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে উৎপাদন পরিকল্পনা ও হিমাগার অবকাঠামোর উন্নয়ন না হলে আগামী বছরও চাষিদের একই দুর্দশা পোহাতে হতে পারে।