আশিকুর রহমান লস্করের ব্যাংক জালিয়াতি ও অর্থপাচার

অনলাইন ডেক্স: কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই, কেবল প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান লস্কর। ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা কৌশলে পাচার করে তিনি গড়ে তুলেছেন বিদেশি সম্পদের সাম্রাজ্য।

সাম্প্রতি দৈনিক সমকালের এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এই সব তথ্য উঠে আসে।

বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল শহর দুবাইয়ে তিনি কিনেছেন ৬২টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ও ভিলা। এর ফলে তিনি দুবাইয়ে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্পত্তির মালিক। এছাড়া কানাডায় রয়েছে তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এসব সম্পত্তি কেনেন তিনি।

পুরোনো জাহাজ আমদানির আড়ালে অর্থপাচার

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে পুরোনো জাহাজ আমদানির আড়ালে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর এই অর্থপাচার কেলেঙ্কারি। পাচারের প্রথম ধাপে অর্থ পাঠানো হয় অর্থ পাচারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, পানামা, লাইবেরিয়া এবং সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে নিবন্ধিত বিভিন্ন কোম্পানিতে। পরে সেখান থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়া হয় দুবাই ও কানাডায়।

এই অর্থপাচারে সহায়তা করেছে বেসরকারি এবি ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। ব্যাংক ঋণখেলাপির মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে আশিকুর রহমান দু’বছর আগে কানাডায় পালিয়ে যান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কানাডায় পালানোর আগে আশিক লস্কর প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১৯০ মিলিয়ন ডলার (২ হাজার কোটি টাকা) পাচার করেন। বর্তমানে সুদে-আসলে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে তাঁর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। অথচ তাঁর বন্ধক রাখা সম্পদের বাজারমূল্য মাত্র ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ২০১৮ সালে লস্করের অর্থপাচারের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি প্রতিবেদন পাঠায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়—মাহিন এন্টারপ্রাইজের ১৫টি এবং গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের ছয়টি পুরোনো জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে এবি ব্যাংক নিয়মনীতি অনুসরণ করেনি।

মাহিন এন্টারপ্রাইজের কোনো আমদানি দায় পরিশোধ না করলেও এলসির (ঋণপত্র) বিপরীতে বারবার বিদেশে অর্থ পাঠানো হয়েছে।এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ও শাখা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে অর্থপাচার হয়ে থাকতে পারে।

এত বড় অর্থপাচার কেলেঙ্কারির প্রমাণ থাকলেও সরকারি কোনো তদন্ত তালিকায় আশিকুর রহমান লস্করের নাম নেই, যা অত্যন্ত বিস্ময়কর। অর্থপাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১১টি অনুসন্ধান দল গঠন করলেও তাদের তালিকায় লস্করের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

এ ঘটনা অর্থপাচারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী তদন্ত ও আইন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত আশিকুর রহমান লস্করের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া।

কে এই আশিকুর রহমান লস্কর?

আশিকুর রহমান লস্করের আদি বাড়ি ফরিদপুর হলেও পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের খুলশীতে বসবাস করছে। তাঁর বাবা আতিউর রহমান লস্কর ছিলেন মেরিন সার্ভেয়ার। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ২০০০ সালে তিনি ভোগ্যপণ্য ব্যবসা শুরু করলেও সুবিধা করতে পারেননি। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে তিনি জাহাজভাঙা ব্যবসায় আসেন।

কিছুদিন পর ব্যবসার হাল ধরেন আশিকুর রহমান লস্কর। কিন্তু তিনি ব্যবসার চেয়ে বেশি মনোযোগ দেন ভুয়া নথিপত্রের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ফয়সাল মোরশেদ খান ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিকে সুবিধা দেন ও বিপুল অঙ্কের ঋণ নেন।

তিনি ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত মেঘনা ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন, যেখানে তাঁর ৪.৫১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

দেশত্যাগ পলাতক অবস্থা

২০২৩ সালের ৫ মার্চ, ঋণখেলাপির মামলায় চট্টগ্রামের একটি আদালত আশিকুর রহমান লস্করের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পরদিন ৬ মার্চ, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে দুবাই হয়ে তিনি কানাডা পালিয়ে যান। তাঁর পরিবার আগে থেকেই টরন্টোর বাসিন্দা ছিল।

সম্প্রতি, আশিকুর রহমান লস্করের ভাই ইনামুর রহমান লস্কর মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে বিদেশ চলে গেছেন।

আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার

লস্করের আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করে, তাঁর দুইটি প্রতিষ্ঠান—মাহিন এন্টারপ্রাইজ ও এআরএল শিপ ব্রেকিং, এবং বেনামি প্রতিষ্ঠান গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নামে এক যুগ ধরে জাহাজ আমদানির জন্য ৩৯টি ঋণপত্র (এলসি) খোলার তথ্য পেয়েছে। এবি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে ১৮টি পুরোনো জাহাজের এলসি খোলা হয়। এর মধ্যে ১৩টি জাহাজের টাকা ঠিকমতো পরিশোধ হলেও, পাঁচটি জাহাজের ৪ কোটি ৪ লাখ ডলার পরিশোধ না করায় ব্যাংক তাঁর নামে ৩২৭ কোটি টাকার ‘ফোর্স ঋণ’ সৃষ্টি করে। বিদেশি ব্যাংকের ঋণ সমন্বয় করতে এই ফোর্স ঋণ ব্যবহৃত হয়।

২০১৩ থেকে ২০১৭ সালে, মাহিন এন্টারপ্রাইজের নামে ১৩ কোটি ২৯ লাখ ডলারের ১৫টি এলসি খোলা হয়। এক বছর মেয়াদী এই এলসিগুলোর অর্থ পরিশোধ না করার ফলে, ব্যাংক আরও ৯৮১ কোটি টাকার ফোর্স ঋণ সৃষ্টি করে। গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নামে আরও ছয়টি এলসি খোলা হয়, যার বিপরীতে ৫ কোটি ২৮ লাখ ডলার বিদেশে পাঠানো হয় এবং ব্যাংককে ৪৬৪ কোটি টাকার ফোর্স ঋণ সৃষ্টি হয়।

এভাবে একজন ঋণখেলাপিকে দিনের পর দিন এলসি খুলতে দিয়ে, এবি ব্যাংক তার আমদানির দায় পরিশোধ করে গেছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রেটিং বিবেচনায় নেওয়া হয়নি এবং লস্করকে ঋণের গ্যারান্টি দেওয়া হয়, যা ব্যাংকের নিয়ম ভঙ্গের শামিল।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি থেকে লস্করের প্রতিষ্ঠানের নামে জাহাজ আমদানি দেখানো হয়। এর মধ্যে নেভিস আইল্যান্ডে নিবন্ধিত অ্যাঞ্জেলিনা শিপিং ইনকরপোরেটেড, ভেনাস ইন্টারন্যাশনাল, ম্যাক্সিমাস শিপিং, প্রিয়াঙ্কা শিপিং, সিকারিও গ্রুপ, এবং লাইবেরিয়ার ট্রাস্ট কোম্পানি অটাম হারভেস্ট মেরিটাইমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, যাদের ক্রেডিট রেটিং ছিল শূন্য বা প্রশ্নবিদ্ধ।

এছাড়া, এবি ব্যাংক বিদেশি ব্যাংকের ঋণ গ্যারান্টির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন না নিয়ে, একাধিক বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্যারান্টি নিয়েছিল। এতে আরও ২৭৩ কোটি টাকার ফোর্স ঋণ সৃষ্টি হয়।

এ বিষয়ে দুদকের তদন্তে লস্করের পাশাপাশি এবি ব্যাংকের তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরীকেও দায়ী করা হয়েছে। তবে ইসহাক চৌধুরী দাবি করেছেন, দুদক তাঁকে ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে এবং তিনি মনে করেন, এই ঘটনা প্রধান কার্যালয়ের জ্ঞাতসারেই ঘটেছে।

এবি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক জানিয়েছেন, তিনি দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে লস্করের ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তবে তিনি জানান, লস্করকে চিনলেও, তাঁর কাছ থেকে কোন সুবিধা নেননি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী বিষয়টির জবাব দেওয়া হয়েছিল।

মধ্যরাতে এলসি খোলার সুযোগ, এবি ব্যাংকের অনিয়ম

এবি ব্যাংক লস্করকে অবৈধ ঋণ সুবিধা দিতে গিয়ে একাধিক ব্যাংকিং নিয়ম ভেঙেছে। ঋণখেলাপি এবং বেনামি ঋণের সুনির্দিষ্ট তথ্য উদ্ঘাটনের পর, বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) কর্তৃক অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়ার পরও ২০২০ সালে লস্করকে আবারও ঋণ প্রদান করা হয়।

এই ঋণ প্রদানের পদ্ধতিতে ব্যাংকিং রীতিনীতি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করা হয়েছে। ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাত ১টা পর্যন্ত শাখা খোলা রেখে, ১৩৪ কোটি টাকার এলসি খোলা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে এই ধরনের সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ছিল। তবে, ব্যাংকের নিয়মিত কর্মকর্তারা লস্করের ঋণ পরিশোধের ঝুঁকি বিবেচনায় এলসি খুলতে রাজি হননি।

এই পরিস্থিতিতে, বাধ্যতামূলক ছুটিতে থাকা এক কর্মকর্তা এবং অন্য শাখার দুই কর্মকর্তাকে ডেপুটেশন দিয়ে, তাদের মাধ্যমে রাতের গভীরে এলসি খোলা হয়। ব্যাংকিং শাখার অভ্যন্তরীণ নিয়ম এবং সতর্কতার অভাব এই অনিয়মের জন্য দায়ী।

কর্মচারীর নামে ৬৭০ কোটি টাকার ঋণ

গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নামে ছয়টি পুরোনো জাহাজ আমদানি দেখিয়ে এবি ব্যাংক থেকে ৬৭০ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে। তবে, এই প্রতিষ্ঠানের কোনো কাগজপত্রে আশিকুর রহমান লস্করের নাম নেই। তবে, সমকাল নিশ্চিত করেছে যে, এই ঋণের সুবিধাভোগী আসলে লস্করই ছিলেন।

গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নিবন্ধন হয়েছিল ২০১৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, এবং এটি নিবন্ধিত হয় মো. মোয়াজ্জেম হোসেন ও তাঁর স্ত্রী সাদিকা আফরিন দীপ্তির নামে। মোয়াজ্জেম, যিনি মাহিন এন্টারপ্রাইজের সাবেক কর্মচারী এবং লস্করের ফুফাতো ভাই, তার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

এবি ব্যাংকের লেনদেনের তথ্য অনুসারে, মাহিন এন্টারপ্রাইজ ও গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করতেন মো. শাহাদাত হোসেন নামে এক ব্যক্তি। আরও দেখা যায় যে, মাহিন এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাব থেকে গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের ঋণ পরিশোধের নজিরও রয়েছে। ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ, সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নামে জাহাজ আমদানির জন্য এবি ব্যাংকে এলসি খোলা হয়, যেখানে শর্ত ছিল অগ্রিম ৩৪ কোটি টাকা জমা দিতে হবে। তবে, এই টাকা লস্করের নিজস্ব উৎস থেকে আসেনি। আইএফআইসি ব্যাংক থেকে মাহিন এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ নেওয়া হয়, এবং ওই ঋণ পরিশোধের জন্য মাহিন এন্টারপ্রাইজের হিসাব থেকে চারটি চেক গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের অনুকূলে জমা করা হয়।

মাহিন এন্টারপ্রাইজ এবং গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের ব্যাংক হিসাবের জমা-উত্তোলনকারী শাহাদাত হোসেন সমকালকে জানান, তিনি মাহিন এন্টারপ্রাইজে হিসাব বিভাগে কাজ করতেন এবং গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের আলাদা লোকদের ব্যাংকে সহায়তা করতেন, যার কারণে তাঁর নাম এসেছে।

মোয়াজ্জেম ফরিদপুরের চর কমলাপুরের মোশারফ হোসেন ও মুজিবুন নেছার সন্তান। যদিও তার নিবন্ধিত বর্তমান ঠিকানা চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর পূর্ব ফিরোজ শাহ কলোনির একটি বাসা, গত ২৩ জানুয়ারি ওই ঠিকানায় গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তার নিরাপত্তা প্রহরী জানায়, ওই নামে বাসায় কেউ থাকেন না। আরও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি সম্ভবত দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

মো. আজম উল্লাহ, লস্করের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রহরী, জানান যে মোয়াজ্জেম লস্করের ফুফাতো ভাই এবং তিনিও দেশের বাইরে পালিয়েছেন।

দুবাইয়ে ৬২টি সম্পত্তি

যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ (সিফোরএডিএস) ২০২০ ও ২০২২ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি তালিকা তৈরি করেছে, যা ২০২৪ সালের মে মাসে অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) ‘দুবাই আনলকড’ নামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে উঠে আসে। এই তালিকায় দেখা যায়, ৪৬১ বাংলাদেশির নামে দুবাইয়ে মোট ৯২৯টি সম্পত্তি রয়েছে।

বাংলাদেশিদের মধ্যে দুবাইয়ের সর্বোচ্চ সম্পত্তির মালিক সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের পরিবার, যার রয়েছে ১৪২টি সম্পত্তি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মালিক আশিকুর রহমান লস্কর, যার নামের ওপর ৩০টি এবং স্ত্রীর নামে ৩২টি সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে দুটি বিশেষ স্থানে, পাম জুমেইরাহ এবং কেম্পিনস্কি হোটেলে বহু দামী অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। দুবাইয়ের এই সম্পত্তিগুলোর আনুমানিক বাজারদর প্রায় ৭১৫ কোটি টাকা।

পাম জুমেইরাহ, দুবাইয়ের কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জে লস্করের ১৫টি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি নিজ নামে এবং ৯টি স্ত্রীর নামে। এই এলাকায় প্রতি অ্যাপার্টমেন্টের দাম ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা। এছাড়া, কেম্পিনস্কি হোটেলে ৫টি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, যার মধ্যে ২টি লস্করের এবং ৩টি স্ত্রীর নামে।

২০২২ সালে আল খুদরাউই টাওয়ারের তৃতীয় তলার একটি ১,৪৪০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট, যা লস্করের নামে ছিল, তা তার ছেলের নামে স্থানান্তরিত হয়েছে। এর বাজারদর প্রায় ১৬ কোটি টাকা।

দুবাইয়ের ভূমিকা

‘দুবাই আনলকড’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিথিল নীতিমালার কারণে দুবাই অপরাধী, পলাতক আসামি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) ২০২২ সালের প্রতিবেদনে দুবাইয়ের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে, বিশেষ করে অর্থ পাচার রোধে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য দুবাই ও কানাডাকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছে।

কানাডায় বিলাসবহুল বাড়ি ও শিপইয়ার্ড লস্করের সম্পত্তি ও ঋণখেলাপি

বিশ্বের ব্যয়বহুল শহরগুলির মধ্যে কানাডার টরন্টো একটি উল্লেখযোগ্য নাম। এখানে আশিকুর রহমান লস্করের রয়েছে তিনটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। টরন্টোতে ‘আশিকুর লস্কর’ নামে আরও চারটি সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই তথ্যটি ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে ‘টেরানেট এক্সপ্রেস’ থেকে সংগ্রহ করা হয়, যা কানাডার সম্পত্তির মালিকানার নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠান।

লস্করের টরন্টো সম্পত্তি:

  • টরন্টো স্ট্যান্ডার্ড কনডেনিয়াম প্ল্যান ২০৩০: ইউনিট ৩, লেভেল ১০
  • টরন্টো স্ট্যান্ডার্ড কনডেনিয়াম প্ল্যান ২০৩০: ইউনিট ১১০, লেভেল ‘ই’
  • টরন্টো স্ট্যান্ডার্ড কনডেনিয়াম প্ল্যান ২০৩০: ইউনিট ১৫৬, লেভেল ‘ই’
  • টরন্টো স্ট্যান্ডার্ড কনডেনিয়াম প্ল্যান ২০৩০: ইউনিট ৬, লেভেল ৪১
  • টরন্টো স্ট্যান্ডার্ড কনডেনিয়াম প্ল্যান ২২০৪: ইউনিট ৩২৯, লেভেল ‘বি’
  • টরন্টো স্ট্যান্ডার্ড কনডেনিয়াম প্ল্যান ২০৩০: ইউনিট ৮০, লেভেল ‘বি’ এবং ইউনিট ৮১, লেভেল ‘বি’

এগুলো লস্করের নামে নিবন্ধিত অ্যাপার্টমেন্ট, যা কানাডায় তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রার অংশ।

বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার ও নকল নামের ব্যবহার

যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফাইন্যান্স আনকাভার্ডের একজন কর্মী জানিয়েছেন, কিছু ব্যক্তি তাদের সম্পত্তি গোপন করতে বিভিন্ন দেশে নামের অংশবিশেষ ব্যবহার করে কোম্পানি নিবন্ধন করান। এই কৌশলটি লস্করও ব্যবহার করতে পারেন, যেন তার সম্পত্তির প্রকৃত মালিকানা অজ্ঞাত থাকে।

লস্করের ঋণখেলাপি অবস্থান

এবি ব্যাংক, যেখানে লস্করের সর্বোচ্চ ১,৭২৯ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে, সবচেয়ে বড় খেলাপি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১,২৫৭ কোটি টাকা মাহিন এন্টারপ্রাইজের ঋণ, ৮ কোটি টাকা এআরএল শিপ ব্রেকিং, এবং ৪৬৪ কোটি টাকা গ্র্যান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজের নামে রয়েছে। এছাড়া, ঢাকা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকেও লস্করের ঋণ খেলাপি রয়েছে।

শিপইয়ার্ড সম্পত্তি বিক্রি

লস্করের মালিকানাধীন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডে বাগান ও বিভিন্ন ফসল চাষ করা হচ্ছে। এর মধ্যে সোনাইছড়ির শিপইয়ার্ডগুলো ঢাকা ব্যাংক দখল করেছে, কিন্তু উপযুক্ত ক্রেতার অভাবে এখনও সম্পত্তি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া, খুলশী হিলসে লস্করের তিনটি বাড়ি রয়েছে, যার মধ্যে একটি বাড়ি ঢাকা ব্যাংক দখল করেছে এবং অন্য দুটি বাড়ি এবি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রয়েছে।

এবি ব্যাংক এবং অন্যান্য ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ের চেষ্টা করছে, তবে এখনও উপযুক্ত সমাধান পাওয়া যায়নি। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সম্পত্তি বিক্রি করার চেষ্টা করলেও, মূল্যবান সম্পত্তির বিক্রিতে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, কারণ কেউ এগুলো কিনতে রাজি হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে নিয়মিতভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে এবং পুরোনো জাহাজ আমদানির আড়ালে কেউ যদি মানি লন্ডারিং করে থাকে, তাহলে তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের জন্যও একটি বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে, এবং এখন পর্যন্ত মাত্র ২৩টি কোম্পানি বৈধভাবে দেশের বাইরে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পেয়েছে। তবে, এই তালিকায় আশিকুর রহমান লস্কর বা তার পরিবারের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। বিদেশে অর্থ পাঠানোর জন্য তিনি প্রতিটি ডলারই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন লঙ্ঘন করে নিয়েছেন।

অর্থ পাচারের অভিযোগ এবং দুদকের ক্লিন সনদ

২০১৮ সালে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) পুরোনো জাহাজ আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের বিষয়টি তুলে ধরে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, বিএফআইইউ দুই দফা প্রতিবেদন দেয়, যাতে লস্করের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল। ২০২১ সালে দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অনুসন্ধানে এর সত্যতা পাওয়া যায়। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়। তবে, ২০২২ সালে লস্করকে ক্লিন সনদ প্রদান করে দুদক, এবং তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়নি।

জাহাজভাঙা শিল্পে লস্করের প্রভাব

বাংলাদেশে জাহাজভাঙা শিল্প দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিবেচিত হলেও, এটি পরিবেশ বিপর্যয় ও শ্রমিকদের নানা ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) তথ্য অনুযায়ী, এই শিল্পে পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে, উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো এখন এই খাতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে, যার ফলে জাহাজভাঙার সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ২০২৪ সালে ১৩২টিতে দাঁড়িয়েছে। এটি গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

শিপ ব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের ফেব্রুয়ারির রিপোর্ট অনুযায়ী, জাহাজভাঙা শিল্পের ঋণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৯২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা খেলাপি। আশিকুর রহমান লস্করের দায়ে এই খেলাপির ৬৯ শতাংশ অবদান রয়েছে, যা শিল্পের স্থবিরতায় বড় ভূমিকা রেখেছে।

লস্করের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ এবং তার জন্য বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্পের দুরবস্থা দেশের অর্থনীতি ও শিল্পখাতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও ক্লিন সনদ প্রদানের কারণে এসব সমস্যা সমাধান হয়নি, ফলে দেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

লস্করের বক্তব্য পাওয়া যায়নি

আশিকুর রহমান লস্করের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে ই-মেইল ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলেও, কোনো উত্তর আসেনি। লস্করের পক্ষে উচ্চ আদালতে বিভিন্ন সময়ে রিট মামলা পরিচালনা করা দুই আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও, তারা লস্করের বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করতে রাজি হননি।

চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে লস্করের মামলা পরিচালনা করা আইনজীবী রাজীব দাশ ২৩ ফেব্রুয়ারি সমকালকে বলেন, জাহাজভাঙা শিল্পে যেমন মুনাফা হয়, তেমনি ক্ষতির মুখেও পড়তে হয়। করোনাভাইরাস মহামারি, ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং অন্যান্য কারণের ফলে লস্কর ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন এবং এসব কারণে তিনি বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, লস্কর দেশে ফিরতে চান, তাই তিনি অর্থঋণ আদালতে মামলা পরিচালনা করছেন। তবে দুবাই ও কানাডায় লস্করের বিপুল সম্পত্তির বিষয়ে তার কোনো তথ্য জানা নেই।

এই আইনজীবী লস্করের বক্তব্য সংগ্রহের জন্য কয়েক দফা সময় চাইলেও, শেষ পর্যন্ত তা প্রদান করেননি।

এছাড়া, এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, তবে তাকে ফোন দেওয়ার পর সাড়া পাওয়া যায়নি।