
প্রতিবেদক: ইসলামী ব্যাংকে ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণে সৃষ্টি হয়েছে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ঘাটতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পূরণের জন্য ইসলামী ব্যাংক আগামী ২০ বছরে ধাপে ধাপে পরিশোধের সময় চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪২ শতাংশ। পরিদর্শনের আগে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ দেখিয়েছিল মাত্র ৩২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে আরও ৩২ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকার গোপন খেলাপি ঋণ উদ্ঘাটিত হয়। এর ফলে প্রভিশনের পরিমাণ এবং ঘাটতিও বহুগুণে বেড়ে যায়।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, শুধুমাত্র চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৪১ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। যেখানে আমানতের পরিমাণ ৩ হাজার ৯২১ কোটি, সেই শাখায় দায় সৃষ্টি হয়েছে ৫৩ হাজার ৫০১ কোটি টাকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, ইসলামী ব্যাংকের বিগত কয়েক বছরের পুঞ্জীভূত অনিয়মে বিপুল খেলাপি ঋণ তৈরি হয়েছে, যার বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ এখন বাধ্যতামূলক। ব্যাংকটির অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়নি। তবে একই ধরনের অনুরোধ আরও ২০টি ব্যাংক করেছে।
প্রভিশন ঘাটতির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। প্রভিশন না থাকলে ব্যাংকের মূলধন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আমানতকারীর অর্থ ঝুঁকিতে পড়ে। বিদেশি ব্যাংকগুলো তখন ইসলামী ব্যাংকের এলসি কনফার্ম করতে অনাগ্রহী হয়। ফলে তৃতীয় কোনো ব্যাংকের গ্যারান্টি নিয়ে এলসি খুলতে হয়, বাড়ে ব্যয়ও।
বর্তমানে নিয়ম অনুযায়ী, স্বাভাবিক ঋণের বিপরীতে ১ শতাংশ, স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্টে ৫ শতাংশ, সাব-স্ট্যান্ডার্ডে ২০ শতাংশ, ডাউটফুলে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। ইসলামী ব্যাংক ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণ করেছে, যেখানে প্রয়োজন ছিল ৭৭ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের আগে ব্যাংকটি তাদের প্রতিবেদনে ২০ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার প্রভিশনের প্রয়োজনীয়তা দেখিয়েছিল। তখন দেখানো হয় তারা ৭ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা সংরক্ষণ করেছে, ফলে ঘাটতি ছিল ১৩ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। নতুন পরিদর্শনে দেখা যায় এই ঘাটতি এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকায়।
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ও ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন পরিদর্শক জানান, আগে নীতিগত সহায়তায় অনেক সময় খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হতো, এমনকি পরিদর্শনেও শিথিলতা ছিল। তবে বর্তমানে কড়াকড়ি পরিদর্শনের ফলে অনেক ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক চিত্র উন্মোচিত হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের মতো আরও অনেক ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণ, আদালতে থাকা ঋণ এবং অনিয়মিত ফান্ড সংক্রান্ত হিসাব পুনঃমূল্যায়নের আওতায় এসেছে।