ইসলামী ব্যাংক দখলের ক্ষেত্রে এস আলম গ্রুপের অভাবনীয় কৌশল

অনলাইন ডেক্স: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ দখলের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ এক অভাবনীয় কৌশল প্রয়োগ করেছিল, যা “মাছের তেলে মাছ ভাজা” প্রবাদটির বাস্তব প্রতিচ্ছবি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তারা ইসলামী ব্যাংক থেকে ১,৭৫০ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে সেই অর্থ দিয়েই বেনামে ব্যাংকটির প্রায় ৯ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়।

ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালনা পদে ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে। ব্যাংকের বিনিয়োগ ও আইন বিভাগের মতামত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই এই ঋণ দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত জামানত গ্রহণ না করেও ঋণ অনুমোদন করা হয়, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের পরামর্শেরও পরিপন্থী।

এস আলম গ্রুপ একক গ্রাহকের ঋণসীমা লঙ্ঘন করায়, কৌশলে ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়। এসময় এক বিদেশি পরিচালককে সভায় অনুপস্থিত রাখতে রাজধানীর একটি হোটেলে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে আটকে রাখা হয়েছিল। ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর গ্রুপটি নামে-বেনামে ঋণের মাধ্যমে লুটপাট অব্যাহত রাখে।

লুটপাটের অর্থ দিয়ে সময় সময় ব্যাংকটির শেয়ার ক্রয়ের ঘটনাও ঘটে। আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ঘটনা ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন একটি দৃষ্টান্ত।

এস আলম গ্রুপের এই কর্মকাণ্ড ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।

২০০২ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক ছিল এস আলম গ্রুপ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ আনুকূল্যে গ্রুপটি একে একে ইসলামী ব্যাংকসহ সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেয়। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে লক্ষাধিক কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গ্রুপটির কর্তাব্যক্তিরা অর্থ বিদেশে পাচার করেন। পরবর্তীতে সরকার বদলের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকের পরিচালনা পদে ভেঙে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে।

এছাড়া, ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান যাচাইয়ে বিশেষ নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএফআইইউ পৃথকভাবে এ বিষয়ে তদন্ত চালাচ্ছে।

বাংলাদেশের ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে, একক ব্যক্তি, পরিবার বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাংকের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারে না। কিন্তু, আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ আনুকূল্যে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের মুষ্টিমেয় শেয়ার কিনে সেসব শেয়ারের বিপরীতে প্রতিনিধি পরিচালক নিয়োগের মাধ্যমে পুরো ব্যাংকের কর্তৃত্ব দখল করে।

২০১৫ সালের শেষ দিকে, আইন লঙ্ঘন করে এস আলম গ্রুপের কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে ১,৭৫০ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়। এই অর্থ বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৯ শতাংশ শেয়ার কেনার কাজে ব্যবহার করা হয়।

সোনালী ট্রেডার্স ৫০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে এবিসি ভেঞ্চারস লিমিটেডের নামে ইসলামী ব্যাংকের ২.০১ শতাংশ শেয়ার কেনা হয়।এস আলম সুপার এডিবল অয়েল: ৮৫০ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে ইসলামী ব্যাংকের ২.০১ শতাংশ শেয়ার কেনা হয়।

এস আলম ভেজিটেবল অয়েল ৪০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ইউনিগ্লোব বিজনেস রিসোর্সেসের নামে ৪.৬৭ শতাংশ শেয়ার কেনা হয়।

২০১৬ সালের মধ্যে আরমাডা স্পিনিং মিলস, জেএমসি বিল্ডারস, এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, গ্রান্ড বিজনেস লিমিটেড এবং ব্লু ইন্টারন্যাশনালের নামে আরও শেয়ার কেনা হয়।

এস আলম গ্রুপের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা এবং নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই দুর্নীতির তদন্তে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। এ ঘটনা ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন এবং অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি দেশের আর্থিক খাতের গভীর সঙ্কটের ইঙ্গিত বহন করে।

 

২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর, বেনামি শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের ব্যাংকের পরিচালনা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে:

  • এবিসি ভেঞ্চারস: জয়নাল আবেদীন
  • প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল: মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুল মতিন
  • এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং: অধ্যাপক ডা. সিরাজুল ইসলাম
  • গ্র্যান্ড বিজনেস লিমিটেড: মিজানুর রহমান
  • এক্সেলশিয়র ইমপেক্স কোম্পানি লিমিটেড: সৈয়দ আবু আসাদ
  • আরমাডা স্পিনিং মিলস: সাবেক আমলা আরাস্তু খান (চেয়ারম্যান হিসেবে)
  • জেএমসি বিল্ডারস: মো. শাহাবুদ্দিন (ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে)
  • ইউনিগ্লোব বিজনেস রিসোর্সেস: জামাল মোস্তফা চৌধুরী

এভাবেই এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঋণ প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে ঋণ কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে এবং তা সেই নির্ধারিত উদ্দেশ্যেই ব্যয় করতে হবে। তবে, এস আলম গ্রুপের ক্ষেত্রে এই নীতিমালা লঙ্ঘন করে ঋণের অপব্যবহার হয়েছে।

সূত্র জানায়, এস আলম গ্রুপকে ব্যাংক লুটপাট ও শেয়ার কেলেঙ্কারিতে সহায়তা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন সাবেক গভর্নর, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবং তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ব্যাংকটির দখল নিশ্চিত করতে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কয়েকজন কর্মকর্তাও সহযোগিতা করেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী এই ঘটনাকে ব্যাংক দখলের নতুন মডেল বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “পূর্বে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ ব্যবহার করে বেসরকারি ব্যাংকে মূলধন জোগানোর উদাহরণ ছিল। কিন্তু, বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ব্যাংকের শেয়ার কেনার ঘটনা নজিরবিহীন এবং সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত। এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট যে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ লোকজনও জড়িত ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল।”

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ারের মধ্যে:

  • ৭৪.৩৩% প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার
  • ১৭.৮৯% বিদেশি শেয়ার
  • ৭.৬০% পাবলিক শেয়ার
  • ০.১৮% ডিরেক্টর শেয়ার

প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারের ৩০.৫৫ শতাংশই বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে নিবন্ধিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • এবিসি ভেঞ্চারস লিমিটেড: ২.০১%
  • এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং: ৩.৪০%
  • প্লাটিনাম এনডেভার্স লিমিটেড: ২.০১%
  • এক্সেলশিয়র ইমপেক্স কোম্পানি: ৩.৪০%
  • গ্র্যান্ড বিজনেস লিমিটেড: ২.০২%
  • লায়ন হেড বিজনেস রিসোর্সেস লিমিটেড: ২%
  • প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল: ২.০১%
  • আরমাডা স্পিনিং মিলস: ২.০১%
  • ব্লু ইন্টারন্যাশনাল: ২.০১%
  • কিংসওয়ে এনডেভার্স লিমিটেড: ৪.৪০%
  • ইউনিগ্লোব বিজনেস রিসোর্সেস: ৪.৬৭%
  • জেএমসি বিল্ডার্স: ২.০১%

পরিচালনা পদে নিয়োগে জালিয়াতি সাবেক ১৩ জন মনোনীত পরিচালকের মধ্যে ১২ জন বেনামি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পর্ষদে বসানো হয়। বাকি একজন ছিলেন বিদেশি শেয়ারহোল্ডার।

এই ঘটনাগুলো ব্যাংকিং খাতে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর এখন উচিত এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

ইসলামী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক দখলের কৌশল:
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের অনুমোদন বিভাগে কর্মরত এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, এস আলম গ্রুপ শেল কোম্পানির মাধ্যমে ইসলামীসহ একাধিক ব্যাংকের শেয়ার দখল করেছিল। এসব শেল কোম্পানির মাধ্যমে সুবিধাজনক ব্যক্তিদের মনোনীত করা হয় এবং তাদের অনেকেই পরে ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্বে আসেন।

এ কাজে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দায়ও অনস্বীকার্য। ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম ঠেকাতে ব্যাংকে ২ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ারধারকের প্রকৃত মালিকানা (আলটিমেট বেনিফিশিয়াল ওনার্স বা ইউবিও) ডেটাবেইস তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, যা এই ধরনের ফাঁকফোকর বন্ধ করার লক্ষ্যে কার্যকর করা হবে।

বিষয়টি নিয়ে বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

একক গ্রাহকের ঋণসীমা লঙ্ঘন:
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক তার মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপকে দিতে পারে। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ ফান্ডেড ঋণ এবং ১০ শতাংশ নন-ফান্ডেড ঋণের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।

তবে, যখন এস আলম গ্রুপকে ঋণ প্রদান করা হয়, তখন একক গ্রাহকের ঋণের সর্বোচ্চ সীমা মূলধনের ৩৫ শতাংশ ছিল। ইসলামী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকের ঋণ ছিল ১,৯৬৮ কোটি টাকা, যা তখনকার অনুমোদিত সীমা ১,৪৫০ কোটি টাকা থেকে ৫১৮ কোটি টাকা বেশি।

এরপরও নতুন করে বিশেষ অনুমোদনে আরও ১,৭৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর ফলে ২০১৫ সালেই গ্রুপটির মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩,৭১৮ কোটি টাকায়। এই ঋণগুলো তেল, চিনি এবং গম আমদানির জন্য প্রদানের কথা বলা হলেও, ঋণের ব্যবহারে নীতিমালা লঙ্ঘন ও অপব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এই ধরনের অনিয়ম ব্যাংকিং খাতে গুরুতর অব্যবস্থাপনার প্রমাণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার অভাব নয়, বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকর তদারকিরও ব্যর্থতা।

২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একটি বোর্ড সভায় আইন বিভাগের মতামত উপেক্ষা করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি ছাড়াই এস আলম গ্রুপের তিনটি ঋণ অনুমোদন করা হয়। একই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হলেও আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে তিনটি পৃথক বোর্ড মেমো উপস্থাপন করা হয়।

প্রথমে শাখা ও জোনাল অফিস থেকে প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে তিনটি ঋণ প্রস্তাব বিনিয়োগ বিভাগে পাঠানো হয়। করপোরেট বিনিয়োগ বিভাগ এ বিষয়ে ১৯টি সুনির্দিষ্ট আপত্তি তুলে ধরে এবং মতামতের জন্য আইন বিভাগে পাঠায়।

আইন বিভাগ জানায়, একই গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের ঋণ আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখানো উচিত নয়। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নেওয়ার পরামর্শ দেয়। বিনিয়োগ বিভাগ থেকেও ঋণসীমা লঙ্ঘন, অপর্যাপ্ত জামানত এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসার কারণ দেখিয়ে ঋণ অনুমোদনের বিপক্ষে সুপারিশ করা হয়।

তবু ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি এই আপত্তি ও সুপারিশ পাশ কাটিয়ে দ্রুত ঋণ প্রস্তাবগুলো বোর্ডে উপস্থাপন করে। সেদিনই পরিচালনা পর্ষদ এই ঋণ অনুমোদন করে।

তৎকালীন পরিচালনা পদে ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা:

  • পরিচালনা পদে:
    • চেয়ারম্যান: ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফা আনোয়ার
    • পরিচালক: আবদুস সালাম এফসিএ (বর্তমানে পুনর্গঠিত বোর্ডের পরিচালক এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান)
    • ব্যবস্থাপনা পরিচালক: মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান (বর্তমানে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান)
  • পর্যবেক্ষক:
    • বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার ইস্কান্দার মিয়া
  • ম্যানেজমেন্ট কমিটি:
    • চেয়ারম্যান: এমডি মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান
    • সদস্য:
      • মাহবুব উল আলম (পরে এমডি এবং এসআইবিএল ব্যাংকের চেয়ারম্যান)
      • শফিকুর রহমান (বর্তমানে হজ ফাইন্যান্সের এমডি)
      • আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া (বর্তমানে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এএমডি)
      • মো. শামসুজ্জামান (পরে ডিএমডি এবং এএমডি পদে পদোন্নতি পান)
      • আব্দুস সাদেক ভূঁইয়া (পরে ব্যাংক দখলের পর পদত্যাগে বাধ্য হন)

এই ঋণ অনুমোদনকে কেন্দ্র করে ব্যাংকের শৃঙ্খলা, আইন-নীতিমালা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের অনিয়ম ব্যাংকিং খাতে গুরুতর দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার উদাহরণ।

 

 

ব্যাংক পরিচালনা ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতি: অনিয়মের অভিযোগ বিতর্ক

তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান আমাদের সময়কে বলেন, “বিষয়টি আমার স্পষ্টভাবে মনে নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি, আমার দায়িত্বকালে কোনো অনিয়ম করে কিছু করা হয়নি।” তিনি আরও জানান, বোর্ড মিটিংয়ের মেমোতে সীমা অতিক্রম করে ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি থাকলেও তা তার জ্ঞাত নয়। “আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, তখন নিয়ম মেনেই কাজ করেছি। ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদের অধিকারভুক্ত। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কি ১০০ কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে?”

তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক আবদুস সালাম এফসিএ বলেন, “আমাদের সময়ে অনিয়ম হওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনিয়মের উল্লেখ থাকলে তা খতিয়ে দেখা উচিত। তবে আপনি যে ঘটনার কথা বলছেন, তা আরও আগের। তখন কোনো ঘটনা ঘটলে সেটিও নিরীক্ষা প্রক্রিয়ায় উঠে আসবে।”

জামানতের ঘাটতি: বড় ঋণ অনুমোদনে ঝুঁকি

২০১৫ সালে এস আলম গ্রুপের জন্য নতুন করে ১,৭৫০ কোটি টাকা বিশেষ ঋণসীমা অনুমোদনের ফলে গ্রুপটির ঋণসীমা দাঁড়ায় ৩,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু এই ঋণের বিপরীতে মাত্র ৩৬৩.৭০ কোটি টাকার জামানত রাখা হয়, যেখানে প্রয়োজন ছিল ৮৮২.৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, জামানতের ঘাটতি ছিল ৫১৯.১০ কোটি টাকা বা ৫৭.৮৫ শতাংশ।

ঋণ অনুমোদনের আগে বোর্ড সভায় উত্তেজনা হট্টগোল

২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩টায় পরিচালনা পর্ষদের সভায় পৃথক তিনটি বোর্ড মেমোর মাধ্যমে ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। কিন্তু গ্রুপটির অনুকূলে আগেই সীমার বেশি ঋণ থাকার কারণে বিশেষ ঋণসীমা বাড়ানো নিয়ে সভায় ব্যাপক হট্টগোল হয়।

এ সময় বিদেশি শেয়ারহোল্ডার ও তৎকালীন ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ আব্দুল্লাহ আল-রাজিকে রাজধানীর একটি হোটেলে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আটকে রাখা হয়। পরবর্তীতে তিনি ছাড়া পেয়ে সন্ধ্যায় ব্যাংকে উপস্থিত হলে সভায় আবার উত্তেজনা দেখা দেয়।

এসব ঘটনা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রক নীতিমালার গুরুতর লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের অনিয়ম রোধে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

জেনেও নিশ্চুপ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র অনুযায়ী, আইন ভেঙে সীমাতিরিক্ত ঋণ অনুমোদনের ঘটনা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারক কর্মকর্তারা জানার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগকৃত পর্যবেক্ষক ইস্কানদার মিয়া।

সভায় তিনি মন্তব্য করেন, “এ ধরনের অনৈতিক ঋণপ্রস্তাব বোর্ডে উপস্থাপনই উচিত হয়নি।” তিনি এই বিষয়টি তার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করার এবং ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি চেয়ে চিঠি লেখার পরামর্শ দেন। কিন্তু তার পরামর্শকে গুরুত্ব না দিয়ে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানের কাছে নালিশ করেন।

এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরে ইস্কানদার মিয়াকে ইসলামী ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হন তৎকালীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. শাহ আলম। এ বিষয়ে ইস্কানদার মিয়া মন্তব্য করতে রাজি হননি। সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এস আলম গ্রুপের ব্যাংক কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এস আলম ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যিনি সুপরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করেছেন। এমন সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে পৃথিবীতে কেউ ব্যাংক ডাকাতি করেছে কিনা, তা জানা নেই। এটি এমন একটি মডেল, যা সব সময় এড়িয়ে চলা উচিত।”

গত ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর এই মন্তব্য করেন। তিনি এটিকে পদ্ধতিগতভাবে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ব্যাংক লুটপাটের ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেন।