
প্রতিবেদক: ২০২৪ সালটি দেশের ব্যাংক খাতের জন্য চিত্রবিচিত্র বছর ছিল। একদিকে কয়েকটি ব্যাংক ইতিহাস গড়ে রেকর্ড মুনাফা করেছে, অন্যদিকে বেশ কিছু ব্যাংক ভুগেছে চরম লোকসানে। সুশাসনের পার্থক্য, খেলাপি ঋণের চাপ ও গ্রাহক আস্থার ওঠানামা এই বৈপরীত্যের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সুত্রের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের তিনটি ব্যাংক প্রথমবারের মতো বার্ষিক এক হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফার মাইলফলক স্পর্শ করেছে। এদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, যাদের মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে কোনো ব্যাংকের সর্বোচ্চ বার্ষিক মুনাফা। এর আগের বছর মুনাফা ছিল ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা—প্রবৃদ্ধি প্রায় ৪১ শতাংশ।
ব্র্যাক ব্যাংক, এইচএসবিসি বাংলাদেশ এবং সিটি ব্যাংক-ও প্রথমবারের মতো এক হাজার কোটি টাকা মুনাফার ঘরে পৌঁছেছে। ব্র্যাক ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে ৭৩ শতাংশ এবং সিটি ব্যাংকের ৬০ শতাংশ।
অন্যদিকে, বেশ কয়েকটি ব্যাংকের জন্য বছরটি ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। জনতা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকসহ নয়টি ব্যাংক বিপুল লোকসানের মুখে পড়ে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের লোকসানই ছিল সবচেয়ে বেশি—৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এবি ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের লোকসান যথাক্রমে ১ হাজার ৯৬৮ কোটি ও ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। এই তিন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা, যা দেশের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
২০২৪ সালে দেশের ৫০টি ব্যাংকের মধ্যে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১৫৮ শতাংশ বেশি।
সিএফএ সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি আসিফ খান বলেন, সুশাসনের তারতম্যই এই বৈষম্যের মূল কারণ। ভালো ব্যাংকগুলো জনগণের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। ফলে আমানতকারীরা কম সুদ পেলেও সেসব ব্যাংকে টাকা রেখেছেন। এসব ব্যাংক ট্রেজারি বন্ড থেকে মুনাফা করে ভালো অবস্থানে পৌঁছেছে। তিনি আরও বলেন,অন্যদিকে, দুর্বল ব্যাংকগুলো অতীতের দুর্নীতি, অদক্ষতা ও গোপন খেলাপি ঋণের কারণে ধসে পড়ছে।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবুর রহমান স্বীকার করেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সম্পদের পুনঃশ্রেণিকরণের কারণে তাঁদের ব্যাংকের লোকসান হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা আগে যেসব সম্পদ নিয়মিত হিসেবে দেখাতাম, সেগুলো এখন শ্রেণিকৃত হওয়ায় প্রত্যাশিত আয় শূন্য হয়ে গেছে।” তবে তিনি আশাবাদী যে, “পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হয়েছে। আমরা মাঠপর্যায়ে ঋণ আদায় ও খেলাপি সম্পদ বিক্রিতে সক্রিয় হয়েছি।”
এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেড এম বাবর খান জানান, বড় কর্পোরেট ঋণগ্রহীতারা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কিস্তি দিতে না পারায় সেসব ঋণ খেলাপি হয়েছে। এর ফলে সুদ থেকে প্রাপ্ত আয় বাদ দিতে হয়েছে। তবে তিনি বলেন, “আমরা এখন পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছি এবং গত ছয় মাসে ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছি।”
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালে দেশে ব্যাংক খাতের মোট আমানত বেড়েছে ১২ শতাংশ বা ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। তবে সংকটে থাকা ৯টি ব্যাংকে আমানত ১৫ হাজার কোটি টাকা কমেছে, যা সামগ্রিক বাজারে আস্থাহীনতার একটি পরিষ্কার ইঙ্গিত।