
প্রতিবেদক: নতুন অর্থবছরে বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসনে বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দুটি নতুন বিভাগ—রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ—গঠন করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই সময়োপযোগী এবং সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। এর মাধ্যমে দেশের কর ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ, দক্ষ ও আধুনিক করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কাজ আলাদা করার এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি উত্তম অনুশীলন। একটি বিভাগ নীতি প্রণয়ন ও আইন প্রণয়নে যুক্ত থাকবে, অন্যটি থাকবে বাস্তবায়ন ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে। এতে করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি যেমন বাড়বে, তেমনি কাজের গতিও বাড়বে। পাশাপাশি এই কাঠামো দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও রাজস্ব চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
তবে এই কাঠামো পরিবর্তন এককভাবে কাঙ্ক্ষিত ফল আনবে না। এর সফলতা নির্ভর করবে আরও কিছু মৌলিক সংস্কারের ওপর। বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা এখনও সীমিত পরিসরে আবদ্ধ। করের আওতা বাড়ানো, অপ্রয়োজনীয় করছাড় কমানো এবং পরোক্ষ করের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে সরে আসতে হবে। বিশেষ করে, আয়করসহ প্রত্যক্ষ করের ভূমিকা বাড়াতে হবে এবং উচ্চ আয়ের নাগরিকদের করের আওতায় আনতে হবে।
একইসঙ্গে, কর ব্যবস্থার ভেতরে বিরাজমান দুর্নীতিকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এটি করতে না পারলে যেকোনো কাঠামোই ব্যর্থ হবে। কর আইন, আপিল প্রক্রিয়া ও বিচারিক কাঠামোকে আধুনিকায়ন করতে হবে। এই ব্যবস্থাগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন ছাড়া কাঠামোগত সংস্কারের সুফল পাওয়া সম্ভব নয়।
প্রতিটি বড় সংস্কারের মতো, এই উদ্যোগের ক্ষেত্রেও কিছু প্রতিরোধ দেখা যাচ্ছে। শুল্ক ও আয়কর ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তা প্রশাসনিক ক্যাডার থেকে নিয়োগের বিরোধিতা করছেন। আবার ব্যবসায়ী মহলের একটি অংশও সন্তুষ্ট নয়, কারণ তারা পুরনো ব্যবস্থার ফাঁকফোকর থেকে সুবিধা নিয়ে আসছিলেন। অতীতে অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং বিশেষ স্বার্থান্বেষীদের কারণে বহু সংস্কার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, এই সংস্কার যাতে সেই পথ না ধরে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নতুন কাঠামো কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আস্থা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। প্রশাসনের কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে কাঠামো থাকবে কাগজে-কলমে, বাস্তবে তার প্রভাব সীমিতই থাকবে।
বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করতে হলে একটি শক্তিশালী, ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই কর ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। এ প্রেক্ষাপটে এনবিআর ভেঙে দুটি বিভাগের গঠন একটি সাহসী ও কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ—তবে এর সফলতা নির্ভর করবে বৃহত্তর কর সংস্কার, বাস্তবায়ন দক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।