এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশ: উন্নতি আছে, তবে মানবসম্পদ সূচকে চ্যালেঞ্জ

প্রতিবেদক: স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য তিনটি মূল সূচক বিবেচনায় নেওয়া হয়—মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচক। বাংলাদেশ গত সাত বছর ধরেই এই তিনটি সূচকে জাতিসংঘ নির্ধারিত মান অতিক্রম করেছে এবং এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করে আসছে। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী মানবসম্পদ সূচকে কিছুটা অবনতি হয়েছে। অন্যদিকে মাথাপিছু আয় এবং অর্থনৈতিক-পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে দেশের অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে।

বর্তমানে এলডিসি থেকে উত্তরণের নির্ধারিত সময় হলো ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর। ২০১৮ ও ২০২১ সালে জাতিসংঘের ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ উত্তীর্ণ হওয়ায় ২০২১ সালেই চূড়ান্তভাবে উত্তরণের জন্য সুপারিশ পায়। তবে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে উত্তরণের প্রস্তুতির সময় দুই বছর বাড়ানো হয়। এখন বাংলাদেশ যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উত্তরণ করে, তবে এটিই হবে প্রথম দেশ, যা তিনটি সূচকে একসঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে এলডিসি থেকে বের হবে।

বিবিএসের হিসাবে দেখা যায়, মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত মান ছাড়িয়ে গেছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয় হতে হয় ১,৩০৬ মার্কিন ডলারের বেশি। অথচ ২০২৫ সালের জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের গত তিন বছরের গড় মাথাপিছু আয় ২,৭৩৪ ডলার, যা ২০২৪ সালে ছিল ২,৬৮৪ ডলার। এক বছরে আয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

তবে মানবসম্পদ সূচকে কিছুটা অবনতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২৪ সালে এই সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৭৭.৫ পয়েন্ট, যা ২০২৫ সালে কমে হয়েছে ৭৭.১। যদিও এলডিসি উত্তরণের জন্য ৬৬ পয়েন্টই যথেষ্ট, তথাপি সূচকের নিম্নগতি একটি অশনিসংকেত। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে অবনতি স্পষ্ট—২০২৪ সালে এই খাতের স্কোর ছিল ৭৭, যা ২০২৫ সালে কমে দাঁড়ায় ৭৫.৮ পয়েন্টে। শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, সাক্ষরতা, লিঙ্গ সমতা ও স্বাস্থ্যসেবার মানের মতো উপসূচক দিয়ে মানবসম্পদ সূচক নির্ধারিত হয়।

অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশ আরও শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ২০২৪ সালে এই সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২১.৯, যা ২০২৫ সালে কমে হয়েছে ২১.৮। এই সূচকে উত্তরণের জন্য ৩২ বা এর কম স্কোর থাকতে হয়। জিডিপিতে কৃষি, শিল্প ও সেবার অবদান, রপ্তানির অস্থিতিশীলতা, দুর্যোগের শিকার হওয়ার হার, উপকূলীয় অঞ্চলের জনসংখ্যার অনুপাত, কৃষি উৎপাদনের অস্থিরতা ইত্যাদি উপসূচক দিয়ে এই সূচক নির্ধারণ করা হয়।

এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে। এতে পরনির্ভরশীলতা কমে এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার সম্ভাবনা জোরদার হয়। তবে এলডিসির তালিকায় থাকা অবস্থায় উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায়, যা হারানোর ঝুঁকিও তৈরি হয়।

এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। প্রতি তিন বছর অন্তর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নের মাধ্যমে এটি সম্পন্ন হয়। যেকোনো দুটি সূচকে মান অর্জন করলেই উত্তরণের সুপারিশ পাওয়া যায়, কিংবা শুধু মাথাপিছু আয় নির্ধারিত সীমার দ্বিগুণ হলেও উত্তরণের যোগ্যতা অর্জিত হয়। এই মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল।

সিডিপির চূড়ান্ত সুপারিশ জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল (ইকোসক) এবং পরে সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত হলে কোনো দেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। এদের অনেকেই উন্নয়নশীল হলেও তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশ হিসেবেই চিহ্নিত। বাংলাদেশ যদি সফলভাবে উত্তরণ করতে পারে, তাহলে এটি শুধু একটি পরিসংখ্যানগত অর্জন নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হবে।