এস আলম নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছয় মাসে বেড়েছে ৮৬,৩৪৭ কোটি টাকা

প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ইসলামী ব্যাংকসহ আটটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছয় মাসে ৮৬,৩৪৭ কোটি টাকা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এর আগে ব্যাংকগুলোর বোর্ড ঋণের তথ্য গোপন রেখে খেলাপি ঋণ কম দেখিয়েছিল। তবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গোপন থাকা ঋণের তথ্য প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।

গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক এস আলম গ্রুপের আটটি ব্যাংকসহ সালমান এফ রহমান ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীন মোট ১৪টি ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ১২টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১.০৩ লাখ কোটি টাকা বেড়েছে। এর মধ্যে-আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৩,৪২৬ কোটি টাকা (সালমান এফ রহমান নিয়ন্ত্রিত)।ইউসিবি ব্যাংকে বেড়েছে ৩,৫৩৫ কোটি টাকা (সাইফুজ্জামান চৌধুরী নিয়ন্ত্রিত)।এক্সিম ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২৯ কোটি টাকা (নজরুল ইসলাম মজুমদার নিয়ন্ত্রিত)

তবে, বোর্ড ভেঙে দেওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে দুটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে।মেঘনা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৯ কোটি টাকা কমেছে।এনআরবিসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩৩৯ কোটি টাকা কমেছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, অনেক ব্যাংক গ্রাহকের ঋণ নিয়মিত দেখিয়ে আসছিল, যদিও প্রকৃত অর্থে সেগুলো খেলাপি ছিল। এখন সেই গোপন ঋণের তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে বলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হঠাৎ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঋণ শ্রেণিকরণ (লোন ক্লাসিফিকেশন) করছে, যার ফলে খেলাপি ঋণের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

একটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র প্রকাশ পাওয়া জরুরি। এটি স্পষ্ট হলে ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোর্ড ভেঙে দেওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ ইসলামী ব্যাংকের।

গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২,৮১৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২১%।বর্তমানে ব্যাংকটির ১৩,১৫৩ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।মাত্র ছয় মাস আগেও ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৭,৭২৪ কোটি টাকা। এই সময়ে খেলাপি ঋণ ২৫,০৯২ কোটি টাকা বেড়েছে।

গত আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের হাতে। তাদের অধীনে ব্যাংকটি ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর এক গোপন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এস আলম গ্রুপ দেশের ১০টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মোট ২.২৫ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
এর মধ্যে-শুধুমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকেই এস আলম গ্রুপ ১.০৫ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ নেওয়া হয়েছে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে, যার পরিমাণ ৪৫,৬৩৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ৫ আগস্ট ‘জুলাই বিপ্লব’-এর পর ব্যাংক খাতের অনিয়ম প্রকাশ পেতে শুরু করে। এতে গ্রাহকরা ব্যাংকের ওপর আস্থা হারিয়ে প্রচুর পরিমাণে আমানত তুলে নিতে শুরু করেন।

কিছু ব্যাংক গ্রাহকদের চাহিদামতো অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঋণ শ্রেণিকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করছে, যা আগামী এপ্রিল থেকে আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে। এর ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।

আইএফআইসি ব্যাংক, যা সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণে ছিল, মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে এর খেলাপি ঋণ ১৩,৪২৬ কোটি টাকা বেড়েছে।

২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ৩,৭৫৬ কোটি টাকা।ডিসেম্বর শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭,১৮২ কোটি টাকা।

একই সময়ে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হাইকোর্টে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে যে, বেক্সিমকো গ্রুপ ১৬টি ব্যাংক ও ৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ৫০,০০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

এর মধ্যে ৮টি ব্যাংকে বেক্সিমকোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৩,১২০ কোটি টাকা।বেক্সিমকোর খেলাপি ঋণের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ও সোনালী ব্যাংক। জনতা ব্যাংক ১৯,৫০৭ কোটি টাকা (২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত)।সোনালী ব্যাংক: ১,৫৪৪ কোটি টাকা।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংক থেকে তার ১৪টি কোম্পানির জন্য ঋণ নিয়েছেন।

ব্যাংকটির প্রধান ও গুলশানসহ অন্যান্য শাখা থেকে মোট ৭,১২৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়।এতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।

দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক একসময় শিকদার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, জয়নুল হক শিকদারের মৃত্যুর পর এটি ধীরে ধীরে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছয় মাসে ৪,৯১৭ কোটি টাকা বেড়ে ২৫,৮৪৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।এটি ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৬০%।প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৮,৭২০ কোটি টাকা।২০২৪ সালের জুনে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২০,৯২৯ কোটি টাকা।

ব্যাপক ঋণ অনিয়ম, সুশাসনের অভাব ও পরিচালনা পর্ষদের দ্বন্দ্বের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংক একটি বড় লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)।

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর, বাংলাদেশ ব্যাংক ইউসিবির বোর্ড ভেঙে দেয়।২০২৪ সালের জুনের তুলনায় ডিসেম্বরে ইউসিবির খেলাপি ঋণ ৩,৫৩৫ কোটি টাকা বেড়ে ৬,৮৪৮ কোটি টাকা হয়েছে।সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে সিআইডি (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ) অনুসন্ধান শুরু করেছে। ২০১৬-২০২১ সালের মধ্যে তিনি ৪৮ লাখ ডলার (প্রায় ৫,৭২৪ কোটি টাকা) ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৬২০টি বাড়ি কিনেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে এবং নতুন করে আরও তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করেছে।

নতুন করে বোর্ড ভেঙে দেওয়া ব্যাংকগুলো হলো— এনআরবিসি ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক ও মেঘনা ব্যাংক।

বোর্ড পুনর্গঠিত হওয়া ব্যাংকগুলোর মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণও ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৪,১৩৫ কোটি টাকা।২০২৪ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণ ছিল ১.০২ লাখ কোটি টাকা।ডিসেম্বর শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৩৬ লাখ কোটি টাকা।বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ,জনতা ব্যাংক: ১৯,১৪৭ কোটি টাকা।অগ্রণী ব্যাংক: ৬,৬০৭ কোটি টাকা।রূপালী ব্যাংক: ৪,৬১৬ কোটি টাকা।সোনালী ব্যাংক: ৩,৪১০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপ, সালমান এফ রহমান, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও অন্যান্য ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলোতে গোপন রাখা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঋণ শ্রেণিকরণ শুরু করায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ব্যাংক খাতে কঠোর সংস্কার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।