খেলাপি ঋণ বাড়ছে, আরও বাড়ার শঙ্কা

অনলাইন ডেক্স: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। গত ডিসেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০.২০ শতাংশ।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় এটি ২ লাখ ১৩১ কোটি টাকা বেশি। শুধু গত বছরের শেষ তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময়ই বলেছিলাম খেলাপি ঋণ বাড়বে। এখন দেখা যাচ্ছে, আমার অনুমান সঠিক ছিল। তবে এটি এখনো সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেনি। সামনের দিনে আরও বাড়তে পারে। তবে আমরা কোনো তথ্য লুকাব না।”

তিনি আরও জানান, সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এটি কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। নতুন বিতরণ করা ঋণ যেন খেলাপি না হয়, সেজন্য আইনগত কঠোরতা আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কয়েকটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ ঋণের নামে বিপুল অর্থ বের করে নিয়েছে, যার মধ্যে অনেকেই এখন পলাতক বা কারাগারে। এস আলম, বেক্সিমকোসহ দেশের শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই এখন খেলাপি।

শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে ঋণ পরিশোধ না করেও নানা সুবিধার মাধ্যমে নিয়মিত হিসাব দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এসব ঋণ এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। তিন মাস আগে এই পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২২ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার: ৪২.৮৩% (তিন মাস আগে ছিল ৪০.৩৫%)।বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার: ১৫.৬০% (তিন মাস আগে ছিল ১১.৮৮%)

২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়। ফলে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ ২ লাখ ১৩১ কোটি টাকা বেড়েছে।

২০২৪ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মাত্র ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন—

আগে ৬ মাস পর ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা হতো, এখন ৩ মাস পর খেলাপি হিসেবে গণ্য হচ্ছে।ভবিষ্যতে একদিন পর থেকেই অপরিশোধিত ঋণ খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবে।

আগে আদালতের নির্দেশে অনেক ঋণ খেলাপির তালিকায় আসত না।এখন এসব রিট বাতিল হওয়ায় প্রকৃত চিত্র সামনে আসছে।বিশেষ সুবিধার আওতায় ঋণ পুনঃতপশিল করার সুযোগ কমানো হয়েছে।

গভর্নর বলেন, “আমরা চাই, ব্যাংক থাকুক বা না থাকুক, আমানতকারীরা যেন তাদের অর্থ ফেরত পান।” এজন্য—

কিছু ব্যাংক একীভূতকরণের পরিকল্পনা চলছে।অমানতকারীর টাকা ফেরত নিশ্চিত করতে বীমা তহবিলের অর্থ দ্বিগুণ করা হচ্ছে।জনগণের আস্থা ফেরাতে আমানত প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে ভারসাম্য বজায় রেখে রিজার্ভ শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর থেকে ধাপে ধাপে ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে।

এর মধ্যে বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে ঋণ পুনঃতপশিল, খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষার জন্য পুরো ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।

এতদিন লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র এখন প্রকাশ্যে আসছে। খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।