গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পরিকল্পনায় বিনিয়োগকারীদের হুঁশিয়ারি

অনলাইন ডেক্স:শিল্পখাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সরকারের পরিকল্পনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। তাঁরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে তারা বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবেন। তাঁদের মতে, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশি পণ্যের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ব্যাহত করবে এবং বিদ্যমান ও নতুন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করবে।

গতকাল (রোববার) পলিসি কনসিডারেশন ফর এনার্জি অ্যাফোর্ডিবিলিটি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পিটিটিভনেস’ শীর্ষক সেমিনারে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এসব মতামত তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাব সরকার বাস্তবায়ন করলে শিল্পখাত টিকে থাকতে পারবে না।

আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে গণশুনানি আয়োজন করবে। সেই প্রেক্ষাপটেই বিনিয়োগকারীরা সতর্কবার্তা দিয়েছেন।

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব

বিভিন্ন গ্যাস কোম্পানির প্রস্তাব অনুযায়ী, শিল্প খাতে অনুমোদিত লোডের বাইরে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা নির্ধারণ করা হতে পারে, যা বর্তমানে ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা। নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্যও একই হারে দাম নির্ধারণের পরিকল্পনা রয়েছে।

সেমিনারে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, দেশের শিল্পখাত মূলত সাশ্রয়ী মূল্যের জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল ছিল, যা এখন হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি জানান, গত পাঁচ বছরে গ্যাসের দাম ২৬৯ শতাংশ বেড়েছে, আর নতুন শিল্প স্থাপনে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের জন্য এটি আরও ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

তিনি বলেন, সাশ্রয়ী গ্যাসের কারণে বাংলাদেশে শিল্পখাত গড়ে উঠেছে। কিন্তু বর্তমানে সরকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ব্যাংক খাত দেউলিয়া, সুদের হার বেশি, এনবিআরে জটিলতা রয়েছে, গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে অথচ সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় দেশে শিল্প টিকে থাকবে না।

সরকারের নীতিগত অস্পষ্টতার কারণে গ্যাসের সরবরাহ ও দাম নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

উৎপাদন ব্যয় ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, যা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আনোয়ার-উল-আলম উদাহরণ দিয়ে বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পর সুতার দাম প্রতি কেজি ২.৪৫ ডলারে পৌঁছেছে, যেখানে ভারত থেকে এটি ২.১৫ ডলারে আমদানি করা সম্ভব। এছাড়া, এলসি খোলার খরচও ৩৯ শতাংশ বেড়েছে।

তিনি সরকারের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা কার জন্য কাজ করছি? আমরা কি চাই দেশে উৎপাদনশীল খাত থাকুক, নাকি তা বন্ধ হয়ে যাক? সরকারের নীতির কারণে মনে হচ্ছে, তারা দেশে শিল্পায়ন চাইছে না। তাহলে কি আমরা উৎপাদন-নির্ভর অর্থনীতি থেকে সেবা-নির্ভর অর্থনীতির দিকে যাচ্ছি?”

ব্যবসায়ীরা মনে করেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি শিল্পখাতের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

শিল্পখাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সরকারের পরিকল্পনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তাঁরা সতর্ক করেছেন যে, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে দেশে বিদ্যমান শিল্প খাত সংকটে পড়বে এবং নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে।

গত (রোববার) পলিসি কনসিডারেশন ফর এনার্জি অ্যাফোর্ডিবিলিটি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পিটিটিভনেস’ শীর্ষক সেমিনারে বিনিয়োগকারীরা এসব উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

সেমিনারে ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাভেদ আখতার বলেন, অনেকে প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীরা কেন আসতে চান না। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, বিনিয়োগকারীদের কাছে অন্য বিকল্পও রয়েছে।

তিনি, যিনি ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি, আরও বলেন যে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য জ্বালানি দুই দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ—একটি হলো মূল্য, আরেকটি টেকসইতা। যেহেতু বেশিরভাগ বিদেশি কোম্পানির নেট-জিরো কার্বন কমিটমেন্ট থাকে, তাই বাংলাদেশের জ্বালানি কৌশল তাদের বিনিয়োগের উপযোগী নয়।

তিনি সরকারকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে জ্বালানি কৌশল পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ব্যবসা বিকশিত হলে, জ্বালানি খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়বে, যা দেশের সামগ্রিক রাজস্ব বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।

ইউরোপিয়ান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (ইউরোচেম) সভাপতি নুরিয়া লোপেজ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবকে “বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক” বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিদ্যমান শিল্পের তুলনায় নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য আলাদা দাম নির্ধারণ করলে তা বৈষম্যমূলক হবে। এতে বাংলাদেশে কে বিনিয়োগ করতে চাইবে?

সরকারকে এই উদ্যোগ থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীরা এটিকে বৈষম্যমূলক বলে মনে করবেন, যার ফলে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্প্রসারণও থমকে যাবে।

তিনি ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ এখনও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুত নয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এটি চান না, এটি শুধু রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ইচ্ছা। অথচ এই পরিবর্তনের ফলে আমাদের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম অভিযোগ করেন যে, “অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্তের কারসাজির মাধ্যমে আগের সরকার এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরিকল্পনা নিয়েছে। অথচ বাস্তবে আমাদের অর্থনৈতিক প্রস্তুতি নেই। এটি অনুসরণ করা হলে তা ব্যবসায়ীদের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় গ্যাসের দাম কমানোর উপায় নিয়ে গবেষণা করা উচিত, কিন্তু তা না করে উল্টো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আনা হচ্ছে।”

তিনি আরও অভিযোগ করেন, আগের সরকারের লোকজন কমিশন খাওয়ার জন্য স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনতে অস্থির ছিল। তারা এখনও বিদেশে বসে কমিশন খাচ্ছে। যদি গ্যাসের দাম না কমানো যায়, তাহলে শিল্প টিকবে না।

তিনি সার উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ সীমিত করে শিল্প উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ (পিইবি) ও ইকোনমিক রিপোর্টারস ফোরাম (ইআরএফ) যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালা, এবং সঞ্চালনা করেন পিইবি’র প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ।

প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। আলোচনায় অংশ নেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন, বিএসআরএম পরিচালক আমীর আলী হোসেনসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা।