গ্যাস সংকট ও বৈশ্বিক শুল্কনীতির ধাক্কায় চাপে দেশের বস্ত্র ও পোশাক খাত

প্রতিবেদক: গ্যাস সংকটের কারণে দেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পে দেখা দিয়েছে মারাত্মক বিপর্যয়। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে রপ্তানি আয়ের প্রধান এই খাতের প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। এর পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নতুন শুল্কনীতি বৈশ্বিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, যা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে প্রভাব ফেলছে।

নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ভুলতা, মাওনা ও টঙ্গীসহ দেশের প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোতে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় অনেক কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। এই খাতের উৎপাদন সচল রাখতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ অত্যাবশ্যক, কারণ স্পিনিং মেশিন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বয়লারে বাষ্প তৈরিতে গ্যাস প্রয়োজন হয়।

গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্প্রতি দাম বাড়ানো হলেও বাস্তব পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং অনেক কারখানাই গ্যাস সংকটে উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। গাজীপুরে ইসরাক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক জানান, তাদের দৈনিক ১৭০ টন সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে তা কমে ৭৫ টনে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে লিটল গ্রুপও তাদের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, বস্ত্র খাতে দৈনিক দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। বর্তমানে স্পিনিং, উইভিং, ডাইং ও ফিনিশিংসহ এই খাতে রয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ, আর পোশাক খাতে আছে ৩০ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতির জন্য এ খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এখন এই খাত দুটি বড় সংকটে পড়েছে—একদিকে গ্যাসের সংকট, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য নতুন শুল্কনীতি।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রস্তাবিত নতুন শুল্কনীতি আপাতত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত থাকলেও এতে পশ্চিমা ক্রেতাদের মধ্যে দ্বিধা দেখা দিয়েছে। এর ফলে গ্রীষ্ম ও শরতের কার্যাদেশ আসতে দেরি হচ্ছে। অনেক ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা এখন সাবধানী অবস্থান নিয়েছেন, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশি কারখানাগুলোর ওপর।

ফজলুল হক বলেন, মার্কিন শুল্কনীতি ঘিরে অনিশ্চয়তার কারণে স্থানীয় বাজারেও সুতার চাহিদা কমেছে। বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল জানান, গ্যাস সংকট এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনেক কারখানা উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। বিটিএমএর হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন একটি স্পিনিং মিল গড়ে ২৫ লাখ টাকা করে লোকসানে পড়ছে। সংগঠনটিতে প্রায় ৫০০ স্পিনিং মিল রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অনেকেই কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।

কারখানা মালিকদের মতে, করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির পর এই খাত কিছুটা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। তবে এবার ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য শুল্কনীতির কারণে নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তার ওপর ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া এবং টাকার মান কমে যাওয়া পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

বর্তমানে ডলারের দাম ১২২ টাকা, যেখানে দুই বছর আগে ছিল মাত্র ৮৫ টাকা। এতে তুলা ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে খরচ বেড়েছে, কার্যকরী মূলধনের সংকট তৈরি হয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, কার্যকরী মূলধন ফুরিয়ে আসছে এবং দেশি-বিদেশি চাপের মুখে এই খাত এখন চরম নাজুক অবস্থায় রয়েছে।