চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

In বন্দর
May 20, 2025

প্রতিবেদক: কর্ণফুলী নদীর তীরে পাহাড়, সমতলভূমি ও বিস্তৃত সাগর উপকূল নিয়ে গঠিত চট্টগ্রামকে ‘প্রাচ্যের রানি’ বলা হয়। উর্দুভাষী কবিরা একে বর্ণনা করেছেন ‘বেহেশতের টুকরা’ হিসেবে। তবে এর পরিচিতি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সীমাবদ্ধ নয়—এই বন্দর প্রাচীনকাল থেকেই বাণিজ্য ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

চট্টগ্রাম ছিল এমন একটি প্রাকৃতিক বন্দরে, যেখানে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চীন, আরব, ও ইউরোপের ব্যবসায়ীরা রেশম ও মশলা নিয়ে আসতেন। চীনের ‘জাঙ্ক’, আরবের ‘ঢো’ ও পর্তুগিজদের ‘ক্যারাক’ জাহাজে মুখর ছিল এই উপকূল। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রিক-রোমান ভূগোলবিদ টলেমি একে পূর্ব গোলার্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দর হিসেবে উল্লেখ করেন।

নবম শতাব্দীতে আরবদের এবং পরে ১৫০০ শতাব্দীতে পর্তুগিজদের দখলে এসে বন্দরটি পরিচিতি পায় ‘পোর্তো গ্র্যান্ডে দে বেঙ্গালা’ নামে। এই সময় থেকেই চট্টগ্রাম হয়ে ওঠে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু।

১৯৫২ সালে চট্টগ্রামে বিএসআরএম নামে দেশের প্রথম ইস্পাত কারখানা স্থাপিত হয়। এরপর ১৯৬৮ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারি প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ও তৈরি পোশাক শিল্পের সূচনাও এখানেই ঘটে। ১৯৭৭ সালে দেশের প্রথম রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাও স্থাপিত হয় চট্টগ্রামে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসংলগ্ন সীতাকুণ্ড এখন দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প হাব। এখানে প্রায় ২০০টির বেশি কারখানা চালু রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইস্পাত, সিমেন্ট, ঢেউটিন, কাঁচ, যানবাহন সংযোজন ও কনটেইনার ডিপো। দেশের মোট ইস্পাতের প্রায় ৫০% ও ঢেউটিনের প্রায় ৭০% এখান থেকেই সরবরাহ হয়।

দেশের ৪২টি ইস্পাত কারখানার মধ্যে বিএসআরএম, একেএস, জিপিএইচ ও কেএসআরএম সর্বাধিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এই চারটির সম্মিলিত উৎপাদন দেশের চাহিদার ৫৩% পূরণ করে। ইস্পাত গলানোর ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের সক্ষমতা দেশের মোট সক্ষমতার ৬২%।

১৯৮৩ সালে চট্টগ্রামে গঠিত হয় দেশের প্রথম EPZ। ৪৫৩ একর জমিতে গড়ে উঠেছে ১৪৪টি কারখানা, যার মধ্যে ৭৮টি পোশাক শিল্প। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত কেইপিজেডে বর্তমানে ৪৮টি কারখানা চালু আছে। কর্ণফুলী EPZ, যেটি ২০০৬ সালে স্থাপিত হয়, বর্তমানে ৭৭ হাজার কর্মী নিয়ে ৪৮টি কারখানায় সক্রিয়।

২০০৭ সাল থেকে ওয়েস্টার্ন মেরিন ও আনন্দ শিপইয়ার্ড মিলিয়ে ৪৪টি সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে ৩৪টি নির্মিত হয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিনে। আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণে চট্টগ্রাম ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের অবস্থানকে জোরদার করেছে।

চট্টগ্রামের বিপুল সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে অন্যতম প্রধান বাধা হলো অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং ঢাকাকেন্দ্রিক নীতিনির্ধারণ। কনটেইনার জট, উচ্চ কার্গো হ্যান্ডলিং খরচ, ও দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থা অর্থনৈতিক গতিশীলতায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।

চট্টগ্রাম তার প্রাচীন গৌরব, আধুনিক শিল্প উন্নয়ন ও বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্ভাবনার সমন্বয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। তবে এই সম্ভাবনাকে পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিকেন্দ্রীভূত নীতিনির্ধারণ অপরিহার্য।