চট্টগ্রাম বন্দরে বাড়তি মাশুল কার্যকর, সারচার্জ নিয়ে টানাপোড়েন

প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম বন্দরে গতকাল বুধবার থেকে নতুন মাশুল কার্যকর হয়েছে। এই বাড়তি মাশুলের চাপ সামাল দিতে কয়েকটি বিদেশি শিপিং কোম্পানি সারচার্জ আরোপ করেছিল। তবে সারচার্জ আরোপের কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ ফ্রান্সভিত্তিক একটি শিপিং কোম্পানির সাতটি জাহাজের অনুমোদন বাতিল করেছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও সতর্ক করা হয়েছে—সারচার্জ প্রত্যাহার না করলে তাদের জাহাজও চট্টগ্রাম বন্দরে পরিচালনার অনুমতি পাবে না। কয়েকটি শিপিং লাইন অভিযোগ করেছে যে তাদেরও এ ধরনের বার্তা দেওয়া হয়েছে।

এ অবস্থায় দুটি শিপিং কোম্পানি ইতিমধ্যে সারচার্জ প্রত্যাহার করেছে বলে বন্দরকে জানিয়েছে।

ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীদের আপত্তি উপেক্ষা করে গত ১৪ সেপ্টেম্বর বন্দরের নতুন মাশুল গেজেট করা হয়। এক মাস পর, গতকাল থেকে বন্দর সে মাশুল আদায় শুরু করেছে। এতে বন্দরের বিভিন্ন সেবার মাশুল এক ধাপে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমে বন্দর কর্তৃপক্ষ শিপিং এজেন্টদের কাছ থেকে এই মাশুল আদায় করে। পরে এজেন্টরা আমদানি–রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে তা তুলে নেয়। তবে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে অনেক কোম্পানি বার্ষিক চুক্তিতে কাজ করে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ভাড়া বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় তারা তাৎক্ষণিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সারচার্জ আরোপ করে।

চট্টগ্রাম বন্দর মাশুল বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পর ৭ অক্টোবর থেকে ধাপে ধাপে চারটি শিপিং কোম্পানি সারচার্জ আরোপ করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—ফ্রান্সের সিএমএ–সিজিএম,সুইজারল্যান্ডের এমএসসি, ডেনমার্কের মায়ের্সক লাইন, দেশীয় এইচআর লাইনস

৭ অক্টোবর সিএমএ–সিজিএম কনটেইনারপ্রতি ২০ ফুটে ৪৫ ডলার সারচার্জ ঘোষণা করে, যা ২৬ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল।

ঘোষণার তিন দিন পর, ১০ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কোম্পানিটির সাতটি জাহাজের অনুমোদন বাতিল করে। অনুমোদন বাতিলের ফলে এসব জাহাজ বন্দর জেটিতে ভিড়তে বা কনটেইনার ওঠা–নামা করতে পারে না। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের অনুমতিপত্রে সারচার্জ আদায় নিষিদ্ধ ছিল, যা তারা ভঙ্গ করেছে।

বাতিল হওয়া সাতটি জাহাজের মধ্যে দুটি ইতোমধ্যে বন্দর জলসীমায় নোঙর করেছিল। কিন্তু অনুমোদন বাতিলের কারণে তারা জেটিতে ভিড়তে পারেনি। চাপের মুখে সিএমএ–সিজিএম সারচার্জ প্রত্যাহার করেছে।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এমএসসিও কনটেইনারপ্রতি ১০০ ডলার সারচার্জের ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে বন্দরকে জানিয়েছে যে, তারা কোনো অতিরিক্ত টাকা নেবে না।

ডেনমার্কের মায়ের্সক লাইন ২০ ফুট কনটেইনারে টার্মিনাল হ্যান্ডলিং চার্জ (টিএইচসি) ১২০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৬৫ ডলার করেছে। ৪০ ফুট কনটেইনারে ২০৫ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩১০ ডলার। তবে তারা এখনো সারচার্জ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়নি।

দেশীয় এইচআর লাইনস প্রতি কনটেইনারে ২৫–৩০ ডলার সারচার্জ আরোপ করেছে এবং তা প্রত্যাহার করেনি। এই চার কোম্পানি চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বন্দরের বড় অংশের পণ্য পরিবহন করেছে বলে বন্দর সূত্র জানিয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরসচিব ওমর ফারুক জানান, নতুন ট্যারিফ কার্যকর হয়েছে এবং জাহাজ কোম্পানিগুলোকে সারচার্জ প্রত্যাহারের জন্য বলা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি কোম্পানি ইতোমধ্যে তা করেছে। তাঁর দাবি, কোনো প্রতিষ্ঠানকে চাপ দেওয়া হয়নি।

বন্দর দিয়ে অন্তত তিন শতাধিক বিদেশি শিপিং কোম্পানি কনটেইনার পরিবহন করে। এর মধ্যে শীর্ষ ১০টি প্রতিষ্ঠানই বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।

বন্দর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যে নামেই তা আদায় হোক না কেন, শিপিং কোম্পানিগুলো বাড়তি মাশুল আমদানি–রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে তুলে নেবে। সরাসরি আদায় করতে না পারলে কনটেইনার পরিবহন ভাড়া বাড়াবে। ফলে পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়বে, যা প্রভাব ফেলবে দেশের সমগ্র বাজারে।

বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ফাইয়াজ খন্দকার বলেন, ‘প্রথমে শিপিং এজেন্টরা মাশুল পরিশোধ করবে, পরে তা গ্রাহকদের কাছ থেকে ভাড়া হিসেবে তুলে নেবে।

চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরামের আহ্বায়ক আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরীর মন্তব্য,পণ্যের দামের সঙ্গে যখন এই বাড়তি মাশুল যুক্ত হবে, তখন এর বোঝা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার কাঁধেই পড়বে।