চট্টগ্রাম বন্দরে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব: মূল্যস্ফীতির মধ্যে নতুন চাপের আশঙ্কা

In বন্দর
June 15, 2025

প্রতিবেদক: দেশজুড়ে যখন মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কষ্টকর করে তুলেছে, তখন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে শুল্ক ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন করে চাপ সৃষ্টি হতে পারে।

গত ২ জুন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বহু প্রতীক্ষিত এই শুল্ক পুনর্নির্ধারণ ইস্যুতে আলোচনা হয়। বৈঠকে নৌপরিবহন উপদেষ্টা জুন মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাগিদ দেন। এর আগেই অংশীজনদের কাছ থেকে লিখিত মতামত চাওয়া হয়েছে।

যদিও প্রস্তাবটি এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে, তবে সম্ভাব্য এই শুল্ক বৃদ্ধির মাত্রা আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। তাঁরা সতর্ক করে বলছেন, খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে, যার চাপ শেষমেশ ভোক্তাদের ওপরই পড়বে।

চট্টগ্রাম বন্দরের চীফ পারসোনেল অফিসার ও মুখপাত্র নাসির উদ্দিন বলেন, ১৯৮৬ সালের পর থেকে শুল্ক হালনাগাদ হয়নি। পরিচালন ব্যয় ও সেবা উন্নয়নের খরচ মেটাতেই এই সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।”

শুল্ক বৃদ্ধির এই প্রস্তাব প্রায় ৫০টি সেবার ওপর প্রভাব ফেলবে। এর মধ্যে রয়েছে বন্দর কর, বার্থিং ফি, ফর্কলিফ্ট চার্জ ও অন্যান্য ইউটিলিটি খরচ। যদিও ২০০৭-০৮ অর্থবছরে কিছু ফি সামান্য বাড়ানো হয়েছিল, বাকি প্রায় সব সেবা তিন দশক ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে একটি ২০ ফুটের স্ট্যান্ডার্ড কনটেইনার (টিইইউ) হ্যান্ডলিংয়ে খরচ পড়ে প্রায় ১৫ হাজার টাকা (১২৩ ডলার)। প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে এই খরচ বেড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা হতে পারে। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, আঞ্চলিক অন্যান্য বন্দরের তুলনায় চট্টগ্রামে এখনো হ্যান্ডলিং খরচ অনেক কম—কলম্বোতে এই খরচ ১০০ ডলার, সিঙ্গাপুরে ৭৫ ডলার, আর চট্টগ্রামে মাত্র ৪৩.৪০ ডলার।

২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের আয় দাঁড়ায় ৫,০৫৫ কোটি টাকা (৪৩০ মিলিয়ন ডলার), যা আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। একই সময়ে উদ্বৃত্ত বেড়ে দাঁড়ায় ২,৯৪৮ কোটি টাকা (২৫০ মিলিয়ন ডলার), যা ৩৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। রাজস্ব আয়ের এই ইতিবাচক প্রবণতা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার যুক্তিতে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব দিচ্ছে।

তবে ব্যবসায়ীদের মত, এটি শুল্ক বাড়ানোর উপযুক্ত সময় নয়। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, “১৫ শতাংশ হারে সীমিত শুল্ক বাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু এত বেশি নয়। তিনি যোগ করেন, ব্যবসায়িক খাত ইতিমধ্যে মুদ্রার অবমূল্যায়ন, পরিবহন ব্যয় ও দুর্বল চাহিদার সঙ্গে লড়াই করছে। অতিরিক্ত শুল্ক চাপ অনেক প্রতিষ্ঠানকেই হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

আমদানিকারকরা বলছেন, প্রস্তাবিত শুল্ক বৃদ্ধি বিদ্যমান সমস্যাকে আরও তীব্র করে তুলবে। রাশেদ ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আক্তার হোসেন জানান, “মাত্র মার্চেই বন্দরের স্টোরেজ ভাড়া চারগুণ বেড়েছে। কাস্টমস জটিলতায় কনটেইনার প্রায়ই ১০ থেকে ১৫ দিন পড়ে থাকে, যেখানে ফ্রি উইন্ডো মাত্র চারদিন। এতে প্রতিদিন প্রতি কনটেইনারে ৪৮ ডলার খরচ হয়, যা আমাদের লাভের মার্জিনে বড় চাপ তৈরি করছে।

তিনি আরও বলেন, যদি শুল্ক দ্বিগুণ হয়, সেই খরচ শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ঘাড়েই চাপানো হবে। আমাদের পক্ষে এই খরচ আর বহন করা সম্ভব নয়।

রপ্তানিকারকরাও ক্ষতির শঙ্কা করছেন, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক বেলায়েত হোসেন বলেন, “ধাপে ধাপে ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে শুল্ক বাড়ানো যেতে পারে। এর বেশি হলে কাঁচামাল আমদানি ব্যয়বহুল হবে, আবার মূল্যবৃদ্ধির কারণে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ব।

বাংলাদেশের ৯৩ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়। গম, ভোজ্যতেল থেকে শুরু করে ভারী যন্ত্রপাতি আমদানি–রপ্তানির প্রাণকেন্দ্র এই বন্দর। এক ধাক্কায় শুল্ক বাড়ালে পুরো সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রভাব পড়বে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, এই সময় শুল্ক বাড়ানো হলে তা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। ব্যবসায়ীরা তাদের খরচ ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেবে। এমন সিদ্ধান্ত বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় ভুল হবে এবং সাধারণ মানুষের জীবনে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে।