
প্রতিবেদক: বন্যায় চাষাবাদে ধাক্কা খাওয়ার পরও এবারে ভরপুর আমন উৎপাদন হয়েছে, এবং চাল আমদানি অব্যাহত রয়েছে লাখ লাখ টন। আগামী এপ্রিলের শেষে বাজারে আসবে বোরো চাল। তবে, চালের দাম এখনো রেকর্ড ছুঁইছুঁই। ভালোমানের সরু চালের কেজি সর্বোচ্চ ৮৫ টাকায় পৌঁছেছে, বেড়েছে মোটা ও মাঝারি চালের দামও।
প্রতিবছর রোজায় শাকসবজি, মাছ-মাংসসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে, কিন্তু এবার এসব পণ্যের দাম ক্রেতার নাগালে রয়েছে। তবে, চালের বাজারে উল্টো। ভোক্তা ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাল সিন্ডিকেটের কার্যক্রমে সরকার সফল হয়নি। বড় মিলারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিটি, প্রাণ, স্কয়ার, আকিজ, এসিআই’র মতো বড় বড় কোম্পানিগুলি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুত করে রাখে। কৃষকের হাতে যে ধান থাকে, তা শেষ হলে শুরু হয় করপোরেট ও মজুতদারের খেলা, যার মাধ্যমে চালের দাম বাড়ানো হয়।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিলার এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। বাজারে চালের ঘাটতি না থাকার পরও দাম বাড়ানো হচ্ছে। সাধারণত রোজায় চালের চাহিদা কম থাকে, তাই বাজার স্বাভাবিক থাকার কথা ছিল। তবে, সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে স্বাভাবিকতা নেই।
মিলাররা সাধারণত ছোট ব্যবসায়ীদের ওপর দায় চাপিয়ে বলছেন, তাদের পক্ষ থেকে দর কমানো হয়েছে, কিন্তু খুচরা ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা করে বাজার বাড়াচ্ছে। তবে, মিলারদের দাবি অনুযায়ী পাইকারি মোকামে চালের দাম বেড়েছে।
ঢাকার বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, গুটিস্বর্ণা বা মোটা চাল ৫৪-৫৫ টাকা, পাইজাম চাল ৫৫-৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিআর-২৮ জাত বা মাঝারি চালের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় ২-৩ টাকা বেড়ে ৬৪-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সরু বা মিনিকেট জাতের চালের দাম, যা এখন ৭৮-৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে এ চালের দাম ছিল ৭৫-৭৮ টাকা, যা এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৭ টাকা বেড়েছে।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১৩%, মাঝারি চালের ১৪%, এবং মোটা চালের ৫% দাম বেড়েছে।
উৎপাদন এলাকায়ও চালের দাম চড়া
এটি শুধুমাত্র ঢাকার বাজারের সমস্যা নয়, উৎপাদন এলাকাগুলোর বাজারেও চালের দাম বেড়েছে। নওগাঁ শহরের আড়তদারপট্টির পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সুকুমার ব্রহ্ম জানান, গত এক সপ্তাহে সরু চালের দাম ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। বড় কোম্পানি এবং মিলাররা চাল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তারা ধান মজুত করে বাজারে দাম বাড়াচ্ছে। দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে মজুতবিরোধী অভিযান না হওয়ায়, করপোরেট পর্যায়ে তদারকির অভাব রয়েছে এবং এই কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।
জয়পুরহাটের আকন্দ অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী আব্দুল আজিজ আকন্দ বলেন, বাজারে কাটারি ধানের আমদানি নেই, তাই চিকন চালের দাম কেজিপ্রতি ২ টাকা বেড়েছে। মোটা চালের ব্যবসায়ীরা সমস্যায় আছেন, কারণ তাদের জন্য দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার জানান, আমদানির কারণে মোটা চালের দাম স্থিতিশীল থাকলেও সরু চালের সরবরাহ কমে গেছে। বড় করপোরেট কোম্পানিগুলি এখন চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তাদের ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে, করপোরেট সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, চালের বাজারের মাত্র ৫ শতাংশ অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, বাকি ৯৫ শতাংশ হাসকিং ও অটো মিলারদের হাতে। তাই, চালের দাম বাড়ানোর অভিযোগকে তারা অসত্য বলে উল্লেখ করেছেন।
উত্তরবঙ্গে মিলাররা বাড়াচ্ছে দাম
কুষ্টিয়ার খাজানগরের চালকল মালিক জয়নাল আবেদিন প্রধান জানান, খাজানগর মোকামে মজুত কমে গেছে এবং বেশিরভাগ মিল অর্ডার নিয়েও চাল দিতে পারছে না। গত কয়েক দিনে উত্তরবঙ্গে ধানের মণ ১০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ২০০ টাকা হয়েছে। ফড়িয়া ও কৃষকের ঘরে সরু ধান নেই এবং মিলাররা বেশি দামে ধান বিক্রি করছে।
মজুত পর্যাপ্ত, তবে দাম বাড়ছে
নওগাঁর বেশ কিছু অটোমেটিক রাইস মিলের গেট বন্ধ ছিল, তবে মিলগুলোতে পর্যাপ্ত চাল মজুত আছে। এছাড়া, বিভিন্ন গোডাউনে নামমাত্র বিক্রি ও মজুত রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আমন মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৭৮ লাখ টন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় পূর্ণ হয়েছে। আমদানিও হচ্ছে প্রচুর, চলতি অর্থবছরের গত ৮ মাসে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪০০ টন চাল আমদানি হয়েছে। তবে, আমদানির শর্ত অনুযায়ী চাল বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে না।
চাল সিন্ডিকেট
কারওয়ান বাজারের চাল ব্যবসায়ী শাহজাহান তালুকদার জানান, শাকসবজি এবং মাছ-মাংসের বাজারে সিন্ডিকেট নেই, ফলে এসব পণ্যের দাম কমেছে। তবে চালের বাজারে সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার সফল হয়নি। উৎপাদন এলাকার মিলাররা কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুত করেছে এবং সরকারের তদারকি না থাকায় দাম বেড়েছে।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, চালের বাজার অস্থির হওয়ার কথা ছিল না, কারণ আমন উৎপাদন রয়েছে এবং ঈদের পর বোরো ধান উঠবে। তবে ব্যবসায়িক পর্যায়ে যথাযথ তদারকি না হওয়ায় দাম বেড়ে গেছে।
সহসভাপতি শহিদুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, বর্তমানে ধানের সংকট নেই এবং প্রচুর চাল আমদানি করা হলেও তা বাজারে বিক্রি হচ্ছে না। মিল পর্যায়ে নাজিরশাইল চালের কেজি ৬৭ টাকা, মিনিকেট চাল ৬৫-৬৬ টাকা এবং মোটা চাল ৪৯-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, মিলাররা কেজিতে ২৫ থেকে ৫০ পয়সা বেশি লাভ করতে পারেন, কিন্তু খুচরা ব্যবসায়ীরা কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা লাভ করছেন।
এভাবে, চালের বাজারে সিন্ডিকেটের হাতে দাম বাড়ানোর সুযোগ নিয়ে ভোক্তা ও কৃষকদের জন্য অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে, যা বাজারের স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে।
দিনাজপুরে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে অভিযান, চার প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
দিনাজপুরে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গতকাল জেলা খাদ্য অধিদপ্তর ও ভোক্তা অধিদপ্তর যৌথভাবে অভিযান চালিয়েছে। অভিযানে চার প্রতিষ্ঠানকে মোট ২৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে, শহরের বাহাদুর বাজারের পাইকারি চালের বাজার এনএ মার্কেটে অতিরিক্ত দাম নেওয়া এবং নিবন্ধন না থাকায় লিয়াকত ট্রেডার্স, সাকিব ট্রেডার্স এবং সুফি রাইস এজেন্সিকে ৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া, পুলহাট এলাকায় জিয়া অটোরাইস মিলে বস্তায় ধানের জাতের নাম ও দাম লেখা না থাকার জন্য ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আরীম আখতার খান জানান, “আমি ঢাকার বাইরে আছি এবং চালের বাজারের বিষয়ে বিস্তারিত জানি না। তবে রোজায় বাজার তদারকি দ্বিগুণ করা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মিল ও পাইকারি পর্যায়ে তদারকি ব্যবস্থা আরও জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমদানি, মজুত এবং বিপণন পরিস্থিতি পর্যায়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। আমদানি করা চাল কীভাবে বিক্রি হচ্ছে, সে বিষয়ে সঠিক নজরদারি করতে হবে। আরও, চালের উৎপাদন ও চাহিদার সঠিক তথ্যভান্ডার তৈরি করা উচিত এবং বাজার ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাল করা প্রয়োজন, যাতে তথ্যের সুরক্ষা এবং প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয়।