ছয় ইসলামি ব্যাংকের বিশৃঙ্খল চিত্র উন্মোচন, একীভূতকরণের পথে বাংলাদেশ ব্যাংক

প্রতিবেদক: এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া ফরেনসিক পর্যালোচনায় দেশের ছয়টি ইসলামি ব্যাংকের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব ব্যাংক হলো—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া তথ্য দিয়ে এসেছে।

ফরেনসিক অডিটে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রেকর্ড অনুযায়ী যেখানে অনাদায়ি ঋণ (NPL) দেখানো হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৪ কোটি টাকা, সেখানে আন্তর্জাতিক অডিটরদের মতে এই ঋণের প্রকৃত অঙ্ক ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঘোষিত অনাদায়ি ঋণের হার ছিল ২১.৪৮ শতাংশ, কিন্তু অডিটে তা উঠে এসেছে ৯৬.৩৭ শতাংশ। একইভাবে, ইউনিয়ন ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই হার ৯৭.৮০ শতাংশ এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ।

এছাড়া ছয়টি ব্যাংকের সম্মিলিত প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। এ ধরনের আর্থিক দুর্বলতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৫ সালের ‘ব্যাংক রেজ্যুলুশন অর্ডিন্যান্স’-এর আওতায় পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণের (মার্জার) পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। শুধুমাত্র বিদেশি বিনিয়োগকারীর কারণে আইসিবি ইসলামী ব্যাংককে এই পরিকল্পনার বাইরে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানায়, গত সরকারের সময়ে এসব ব্যাংকের পরিচালনায় রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বজনপ্রীতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ভুল তথ্য সরবরাহ করা হতো। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা ছিল চারটি ব্যাংকের সঙ্গে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর আমানত ও ঋণের ভারসাম্যও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। ছয়টি ব্যাংক ১ লাখ ৬০ হাজার ৩০ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ রেখেছে, যা ব্যালান্স শিটে ঝুঁকিপূর্ণ চাপ তৈরি করছে।

ফরেনসিক অডিটে কেপিএমজি এবং আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং যুক্ত ছিল। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এখন মার্জার কার্যক্রম শুরু হলেও, এক্সিম ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এই উদ্যোগে আপত্তি জানিয়েছে। তাদের দাবি, তারা অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় আর্থিকভাবে বেশি স্থিতিশীল এবং একীভূতকরণ তাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় চাপ তৈরি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য গঠিত ব্যাংক রিস্ট্রাকচারিং অ্যান্ড রেজোলিউশন ইউনিট মার্জার বাস্তবায়নে কাজ করছে, তবে অভিজ্ঞতার অভাবে প্রক্রিয়াটি ধীরগতিতে চলছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেছেন, “নিয়ন্ত্রকের সিদ্ধান্ত ভালো, তবে এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।”

ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি মো. আরফান আলী বলেন, “এই ধরনের ফরেনসিক পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ব্যাংকগুলোর স্বনির্ভরতা যাচাই করার সুযোগ দেয়। একইসঙ্গে, খেলাপিদের কাছ থেকে কঠোরভাবে ঋণ আদায় ও ভবিষ্যৎ সংকট প্রতিরোধে আরও শক্তিশালী তদারকি প্রয়োজন।”

এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বড় পদক্ষেপ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।