
প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ব্যাংক ২০টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে (এনবিএফআই) ‘লাল তালিকাভুক্ত’ করেছে। কারণ, প্রতিষ্ঠানগুলো জামানতের তুলনায় তিন গুণেরও বেশি ঋণ বিতরণ করেছে, যার ফলে সেগুলোর ৮৩ শতাংশের বেশি ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এতে করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তারল্য সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে এবং আমানতকারীদের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ২০টি প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের প্রায় ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা আমানত রয়েছে। বিপরীতে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকার জামানতের ভিত্তিতে তারা ঋণ দিয়েছে ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, গড়ে ঋণের বিপরীতে জামানতের পরিমাণ মাত্র ২৬.৭৩ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব ঋণ প্রদান হয়েছে যথাযথ মূল্যায়ন ছাড়াই, এমনকি জামানতের যথার্থতা নিরীক্ষার জন্য স্বাধীন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাহায্যও নেওয়া হয়নি।
এর ফলস্বরূপ, এফএএস ফাইন্যান্স, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ও পিপলস লিজিং-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৯০ শতাংশেরও বেশি।
‘লাল তালিকাভুক্ত’ ২০ প্রতিষ্ঠান হলো—সিভিসি ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, হজ ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, উত্তরা ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বিআইএফসি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স এবং এফএএস ফাইন্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছে—তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে না কেন তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, আমাদের মূল্যায়নে অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠান আর চলার মতো অবস্থায় নেই। খেলাপি ঋণ ৮০–১০০ শতাংশের মধ্যে, যা অবসায়ন বা একীভূতকরণ ছাড়া আর কোনো সমাধানযোগ্য নয়। তার জন্য প্রয়োজন প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-চেয়ারম্যান কান্তি কুমার সাহা বলেন, গণমাধ্যমে নোটিশের খবর প্রকাশ পাওয়ায় খাতটির প্রতি আস্থা আরও কমে গেছে।
ইউনিয়ন ক্যাপিটালের এমডি এএনএম গোলাম সাব্বির বলেন, “সুপরিচিত কিছু বড় ব্যবসায়ী খেলাপি হওয়ায় আমরা চরম সমস্যায় পড়েছি। পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের সিদ্ধান্তের পর থেকেই আমানতকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ৯০ শতাংশ আমানতকারী টাকা ফেরত চাইছেন, অথচ আমরা ব্যাংক থেকে এক টাকাও পাইনি।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব মন্তব্য করেন, এনবিএফআইগুলোর মূল ব্যর্থতা হলো ঋণগ্রহীতার পরিশোধ সক্ষমতা যাচাই না করা। জামানত হচ্ছে দ্বিতীয় নিরাপত্তা, কিন্তু তারা প্রথম ধাপেই ব্যর্থ হয়েছে।
সব মিলিয়ে, এই অনিয়ম ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম একটি অংশ এখন গভীর অনিশ্চয়তায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি ও দ্রুত সংস্কার ছাড়া এ খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।