জাহাজ ভাঙা শিল্প: পরিবেশ বান্ধব উদ্যোগের জরুরি প্রয়োজন

প্রতিবেদক: বাংলাদেশে জাহাজভাঙা শিল্পের পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া এখনও ধীরগতিতে চলছে, যা পরিবেশ ও অর্থনীতি উভয়ের জন্যই উদ্বেগজনক। জাহাজভাঙা শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও, যথাযথ আর্থিক প্রণোদনা না থাকায় পরিবর্তন অনেকটাই শ্লথ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, হংকং কনভেনশনের অধীনে চলতি বছরের জুনের মধ্যে এই শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করতে না পারলে, বিদেশ থেকে জাহাজ ভাঙার জন্য পাঠানো হবে না।

২০১৭ সালে, পিএইচপি শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ড বাংলাদেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক সনদ লাভ করেছিল। তবে, বিএসবিআরএ (বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন) জানাচ্ছে, মার্চ পর্যন্ত মাত্র সাতটি প্রতিষ্ঠান এই সনদ পেয়েছে, যখন দেশে ২৪৮টি জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৩০-৩৫টি প্রতিষ্ঠান এখনও সচল।

তসলিম উদ্দিন কেআর শিপ রিসাইক্লিংয়ের মালিক, জানিয়েছেন যে আর্থিক প্রণোদনার অভাবে শিল্পের পরিবেশবান্ধব পরিবর্তন প্রক্রিয়া দ্রুত হচ্ছে না। একটি ছোট প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশবান্ধব করতে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকা প্রয়োজন এবং সেই টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য ১০ থেকে ১২ বছর বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।

বিএসবিআরএ’র আশঙ্কা, আগামী জুনের পর হংকং কনভেনশন মেনে না চলা দেশগুলোতে ভাঙার জন্য জাহাজ পাঠানো হবে না, যার ফলে খাতে কর্মরত প্রায় আট হাজার থেকে নয় হাজার কর্মী ও তাঁদের পরিবার বিপদে পড়বে। শ্রম অধিকার কর্মীরা বলেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে জাহাজভাঙা সস্তা হওয়ায় কম বিনিয়োগ প্রয়োজন, কিন্তু পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে খরচ অনেক বেশি হওয়ায় মুনাফা কমে যায় এবং মালিকরা এতে আগ্রহী নয়।

বিএসবিআরএ’র সভাপতি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয় তাদের খাতকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে লাল তালিকায় রেখেছে, ফলে তারা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো শুধু জাহাজ কেনার জন্য ঋণ দেয়, শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের উন্নয়নের জন্য ঋণ দিতে তারা রাজি নয়।

বিশ্বব্যাংকের ২০১০ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, সীতাকুণ্ড উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে বিপজ্জনক পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে, যেমন সিসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, পারদ, অ্যাসবেস্টস এবং ভারী ধাতু। গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, ২০১০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এসব বিপজ্জনক পদার্থ ওই এলাকার মাটি এবং পানিতে জমা হতে পারে।

এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্পে পরিবেশগত মান বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এটি পরিবেশ ও শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিকর না হয়।

জাহাজ ভাঙার পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা প্রবাল বড়ুয়া বলেন, “শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের বর্জ্য প্রায়ই বঙ্গোপসাগরে পড়ছে, যা সাগরের বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।” বিশেষত, মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তেলের ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান পোড়ানোয় আশপাশের অঞ্চলের বাতাসের গুণগত মান খারাপ হচ্ছে। তেল ও ক্ষতিকর রঙ বঙ্গোপসাগরে ছড়িয়ে পড়ায় সামুদ্রিক প্রাণীও হুমকিতে পড়েছে, যার ফলে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং জেলেরা সংকটে পড়ছেন।

এছাড়া, প্রচলিত পদ্ধতিতে জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিকরা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত। অধিকাংশ শ্রমিকই নিম্নবিত্ত ও অদক্ষ, যারা হেলমেট, গ্লাভস বা বুটের মতো মৌলিক সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করেন। জাহাজ ভাঙার সময় বিস্ফোরণে অনেক শ্রমিক মারা যান, আবার অনেক শ্রমিক উঁচু স্থান থেকে পড়ে গিয়ে বা বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে মৃত্যু বরণ করেন। এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কমপক্ষে ২৩১ শ্রমিক নিহত হয়েছেন এবং তিন শতাধিক শ্রমিক গুরুতর আহত হয়েছেন।

মারাত্মক দুর্ঘটনার পাশাপাশি, শ্রমিকরা নিয়মিত অ্যাসবেস্টস, সীসা, এবং বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে শ্বাসযন্ত্রের রোগ ও ত্বকের রোগসহ ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে, পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের সার্বিক নিরাপত্তা এবং পরিবেশগত ঝুঁকি কমানোর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানে কাজ করা মোহাম্মদ আলী বলেন, এখানে কাজ করার সময় সুরক্ষা সরঞ্জাম পরা বাধ্যতামূলক। শ্রমিকদের জন্য আরও উন্নত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।অপর পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানের কর্মী আবুল কালাম বলেন, “প্রচলিত প্রতিষ্ঠানের তুলনায় পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানে মজুরি বেশি এবং তা নিয়মিত দেওয়া হয়, যা শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করে।

এছাড়া, একটি পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক চান মিয়া জানান, “আমরা উৎসব ভাতা পাই, যা অধিকাংশ প্রচলিত প্রতিষ্ঠানে নেই। পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানে কাজ করা নিরাপদ।”

হংকং কনভেনশনের আওতায় চলতি বছরের জুনের পর যদি বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের প্রচলিত জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠানগুলোয় পুরোনো জাহাজ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, জানতে চাইলে বিএসবিআরএ সভাপতি জহিরুল ইসলাম বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিবেশবান্ধব সনদ প্রক্রিয়াধীন। শিল্প মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি, যাতে পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জাহাজ পাঠানোর ব্যবস্থা নেয় বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো।

তিনি আরও বলেন, এটি না হলে এ শিল্প সংকটে পড়ে স্থবির হয়ে যেতে পারে।

গত বছর বাংলাদেশ ছিল জাহাজ ভাঙার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে পছন্দের গন্তব্য। এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম জানাচ্ছে, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী ভাঙা ৪০৯ জাহাজের মধ্যে ১৩০টি বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল।