টার্মিনাল সম্প্রসারণে বাড়ছে ঝুঁকি, নিরাপত্তা জোরদারে কাস্টমসের সংস্কার প্রস্তাব

প্রতিবেদক: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ১ ও ২-এ একসঙ্গে আটটি ইনকামিং ফ্লাইটে প্রায় চার হাজার যাত্রী নামার সুযোগ থাকলেও পিক আওয়ারে এ সংখ্যা দুই থেকে তিন হাজারে দাঁড়ায়। কিন্তু কাস্টমস হলে একসঙ্গে প্রবেশ করতে পারেন মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ জন যাত্রী। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সিস্টেম না থাকায় সবাইকে তল্লাশি করা সম্ভব হয় না।

নতুন টার্মিনাল ৩-এ থাকবে ১৬টি বেল্ট, যেখানে একসঙ্গে ১৬টি ফ্লাইটে প্রায় আট হাজার যাত্রী নামতে পারবেন। তবে এখানকার কাস্টমস হল অপেক্ষাকৃত ছোট হওয়ায় একত্রে প্রবেশ করতে পারবেন ২০০ থেকে ২৫০ জন। যাত্রী সংখ্যা বাড়লেও তল্লাশি সক্ষমতা বাড়ছে না। একদিকে অধিক যাত্রীকে তল্লাশি করলে সেবার মান কমে যায়, অন্যদিকে কম তল্লাশি করলে চোরাচালানের ঝুঁকি বাড়ে। এই সীমাবদ্ধতায় ঢাকা কাস্টম হাউজ স্বল্প জনবল ও সরঞ্জাম নিয়ে সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফলে বিমানবন্দরটি বাণিজ্যিক আমদানি ও চোরাচালানের অন্যতম পথ হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি ঢাকা কাস্টম হাউজ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সিস্টেমকে কার্যকর করতে বিদ্যমান সিসিটিভির সঙ্গে এআই বেজড ফেসিয়াল রিকগনিশন (FRC) ক্যামেরা স্থাপন করা জরুরি। এটি সন্দেহভাজন ও নিয়মিত যাত্রীদের সনাক্ত করে কর্তব্যরত কর্মকর্তাকে সতর্ক করবে।

বিমানবন্দরের ক্যাটারিং গেট ও ৮ নম্বর গেটে ভেহিকল স্ক্যানার বসানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। ক্যাটারিং সার্ভিস এলাকায় বর্তমানে কাস্টমসের কোনো দায়িত্ব নেই, অথচ এ দুটি গেট দিয়ে অতীতে স্বর্ণ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। তাই খাবার ও উচ্ছিষ্ট বহনের গাড়িগুলো স্ক্যান করার জন্য ক্যাটারিং ভবনের সামনে একটি স্ক্যানার এবং ৮ নম্বর গেটে আরেকটি স্ক্যানার বসানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

কার্গো শুল্কায়ন ব্যবস্থায় ‘অ্যাডভান্স কার্গো ইনফরমেশন সিস্টেম’ (ACIS) চালুর প্রস্তাব এসেছে, যা থেকে একটি কেন্দ্রীভূত সিস্টেমের মাধ্যমে আগাম আমদানি তথ্য সংগ্রহ করা যাবে। বর্তমান অ্যাসাইকুডা সিস্টেম পুরোপুরি অটোমেটেড না হওয়ায় ফিজিক্যাল নথিপত্র এখনো বাদ যায়নি, যা বিশ্বমানের নয়।

বিমানবন্দরে চারটি শিফটে গড়ে ১৬-১৭ জন কর্মকর্তা কাজ করেন। পিক আওয়ারে একসঙ্গে ছয়-সাতটি ফ্লাইট ল্যান্ড করে, ফলে প্রায় পাঁচ হাজার যাত্রী হয় একসাথে। চারটি স্ক্যানারে মাত্র ৪০-৪৫ মিনিটে ৬০-৭০টি ব্যাগ স্ক্যান হয়, বাকিগুলো স্ক্যান না করেই চলে যায়। আধুনিক দেশগুলোতে এখন এয়ারসাইডে বেল্টভিত্তিক স্ক্যানার বসানো হয়, যাতে সব ব্যাগ একযোগে স্ক্যান হয়ে যায় এবং সন্দেহভাজন ব্যাগ রেড চ্যানেলে পাঠানো যায়।

এ ছাড়া অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন (API) সিস্টেম চালুর প্রস্তাব এসেছে, যার মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রীদের আগেই চিহ্নিত করে তল্লাশির আওতায় আনা যাবে। পর্যাপ্ত হিউম্যান বডি স্ক্যানার, বারকোড স্ক্যানার ও পেলেট স্ক্যানার বসিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে অটোমেশন করা যায়, যাতে সময় ও জনবল উভয়ই সাশ্রয় হয়।

বর্তমানে কাস্টমসের কুরিয়ার ইউনিটে ই-কমার্স, নমুনা, উপহার ইত্যাদির জন্য এক্সপ্রেস ডেলিভারি সিস্টেম নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো পিসিসি কোড চালু করে দ্রুত চালান শনাক্তকরণ ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে।

রফতানি কার্গো টার্মিনালে পর্যাপ্ত জায়গা থাকলেও স্ক্যানার নেই, ফলে সব পরীক্ষা কায়িকভাবে করতে হয়। তাই সেখানে একটি ভেহিকল ও একটি পেলেট স্ক্যানার বসানোর সুপারিশ করা হয়েছে। একই ব্যবস্থা নতুন রফতানি টার্মিনালেও নেওয়ার পরামর্শ এসেছে।

এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস– নিরীক্ষা, আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য) কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, টার্মিনাল ৩-এ এয়ারসাইডে স্ক্যানার বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডাইভারটিং মেকানিজম বসানোর চিন্তা থাকলেও জায়গার অভাবে তা সম্ভব হয়নি। আরএফআই ট্যাগ বসানোর চিন্তাও আছে, তবে এখনো এমন কোনো মেশিন পাওয়া যায়নি, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্যাগ বসাতে পারে।

তিনি আরও জানান, উন্নত দেশের মতো ওয়াকথ্রু হিউম্যান বডি স্ক্যানার ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে, যা প্রতি ঘণ্টায় ৫০০ ব্যক্তি স্ক্যান করতে পারে। প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনালের জন্য দুটি এবং তৃতীয় টার্মিনালের জন্য দুটি—মোট চারটি মেশিন কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

এআই বেজড ক্যামেরা সংস্থাপন বিষয়ে কাস্টম হাউজের কাছে স্পেসিফিকেশন চাওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, এসব বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিবিড়ভাবে কাজ করছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো ব্যাগেজ স্ক্যানার কেনার প্রক্রিয়া চলছে। এগুলো স্থাপন করা গেলে বেল্টে ওঠার আগেই সব ব্যাগ স্ক্যান করা সম্ভব হবে, যা নিরাপত্তা এবং রাজস্ব উভয় দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।