
প্রতিবেদক: বাংলাদেশে টানা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থাকায় দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের ওপর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে সরকারের ভর্তুকিমূল্যে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি কমে যাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে মাস পর্যন্ত সরকারি সংস্থাগুলো প্রায় ২৬ লাখ ৩২ হাজার টন খাদ্যশস্য বিতরণ করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় পাঁচ শতাংশ কম।
অন্যদিকে, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) দেড় মাস ধরে ভর্তুকিমূল্যে বাজার দরের চেয়ে কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন তেল, ডাল, চিনি ইত্যাদি বিক্রি বন্ধ রেখেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, এই কার্যক্রম শুরু করতে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন, যা পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করা হবে। এর আগে টিসিবির প্রতিটি ট্রাক থেকে সপ্তাহে ছয় দিন গড়ে ৪০০ জন ক্রেতা ভর্তুকিমূল্যে পণ্য কিনতে পারতেন। বর্তমানে টিসিবির এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে প্রায় ৪৯ লাখ কার্ড সচল রয়েছে, বাকিগুলোর যাচাই-বাছাই চলছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ৮ মে পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় খাদ্য বিতরণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এফডব্লিউপি কর্মসূচিতে বিতরণ ৬৩ শতাংশ কমে ৫৯ হাজার টনে নেমেছে, ভিজিএফ কর্মসূচিতে ১১ শতাংশ কমে ১.৫৩ লাখ টন এবং ভিজিডি কর্মসূচিতে ৪০ শতাংশ কমে ১.৮৭ লাখ টন হয়েছে। এ ছাড়া মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেড় লাখ টন চাল ও গম বিতরণ কার্যক্রমও এখনও স্থগিত আছে। খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার জানান, বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও মন্ত্রণালয়টি এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের ঘাটতি এবং ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২২.৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা ২০২২ সালে ছিল ১৮.৭ শতাংশ। একই সঙ্গে অতিদারিদ্র্যের হার বেড়ে ৯.৩ শতাংশে দাঁড়াতে পারে এবং নতুন করে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ অতিদারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত ছিল খাদ্য বিতরণ কার্যক্রম আরও জোরদার করা এবং টিসিবির ভর্তুকি বিক্রি চালু রাখা। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “গত দুই বছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে।” ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, “বর্তমানে ভর্তুকি দামে যে পরিমাণ খাবার একজন দরিদ্র মানুষ পান, তা তার পরিবারের জন্য যথেষ্ট নয়। কাজেই এই কার্যক্রম বন্ধ রাখা উদ্বেগজনক।”
চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার আগামী অর্থবছরে খাদ্য ভর্তুকির বাজেট ১২ শতাংশ বাড়িয়ে ৮,১০০ কোটি টাকা করার পরিকল্পনা নিয়েছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মেয়াদও পাঁচ মাস থেকে ছয় মাসে উন্নীত করা হবে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে এক লাখ টন খাদ্যশস্য বিতরণের প্রস্তুতি চলছে, যা আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে পাঠানো হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।