
প্রতিবেদক: চলতি বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি বেড়ে গেছে বলে একটি জরিপে উঠে এসেছে। ৫০টি দেশের ১৬৭ জন অর্থনীতিবিদের মধ্যে ১০১ জন মনে করেন, এই ঝুঁকি ‘উচ্চ’ বা ‘খুব উচ্চ’ পর্যায়ের। এ বিপদ বাড়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষ করে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কনীতি (যদিও তা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত) ব্যবসায়িক আস্থায় বড় ধরনের ধস নামিয়েছে এবং বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগেও এই অর্থনীতিবিদদের বেশিরভাগই প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে আশা করেছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের উদ্যোগে বিশ্ববাণিজ্যের নতুন কাঠামো গঠনের চেষ্টা, বিশেষ করে আমদানির ওপর ব্যাপকহারে শুল্কারোপ, অর্থনীতিতে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর প্রভাব বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারে পড়েছে, বাজার মূলধন কমেছে ট্রিলিয়ন ডলার পরিমাণ, বিনিয়োগকারীদের আস্থাও নড়বড়ে হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৩০০ জনেরও বেশি অর্থনীতিবিদের মধ্যে কেউই ট্রাম্পের শুল্কনীতিকে ইতিবাচকভাবে দেখেননি। বরং ৯২ শতাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এটি ব্যবসায়ীদের মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মাত্র ৮ শতাংশ নিরপেক্ষ মত দিয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই উদীয়মান অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করছেন।
জরিপ অনুযায়ী, ২০২৫ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ করা হয়েছে, যেখানে জানুয়ারির পূর্বাভাস ছিল ৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অবশ্য ২ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৮টি অর্থনীতির মধ্যে ২৮টির প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস কমিয়ে আনা হয়েছে। একই সঙ্গে ২০২৬ সালের দিকেও প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ খুব একটা নেই বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁদের মতে, শুল্কনীতির ফলে সৃষ্ট মন্দা থেকে সহজে উত্তরণ সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে হলেও ট্রাম্পের কারণে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা চুক্তিতে যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। স্টেট স্ট্রিটের ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার প্রধান কৌশলবিদ টিমোথি গ্রাফ বলেছেন, এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন। এমনকি এখনই সব শুল্ক তুলে নেওয়া হলেও সেই বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষতি সহজে পূরণ হবে না।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা সুদের হার বাড়িয়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও নতুন করে ট্রাম্পের নীতির ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও বেকারত্ব বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যার ফলে স্ট্যাগফ্লেশনের আশঙ্কাও দিন দিন বাড়ছে। জরিপে আরও দেখা গেছে, ২৯টি প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে ১৯টি চলতি বছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও আগামী বছর এই সংখ্যা কিছুটা কমে ১৫টিতে দাঁড়াতে পারে।
সব মিলিয়ে, ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতির প্রভাব কেবল যুক্তরাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পুরো বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এখন বিশ্বনেতারা কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন এবং একটি স্থিতিশীল বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করেন, সেটিই দেখার বিষয়।