
প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাপান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা এ ঘোষণাকে “গভীরভাবে দুঃখজনক” বলে অভিহিত করেছেন। বহুদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সংঘাত এড়াতে জাপান নানা রকম কূটনৈতিক উদ্যোগ নিলেও এখন সেটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
বিশেষ করে জাপানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাত, গাড়িশিল্প বর্তমানে চাপে রয়েছে। দেশটি চায় এই শিল্পে কিছু ছাড় দেওয়া হোক, তবে তারা চালের বাজার উন্মুক্ত করতে রাজি নয়। এরই মধ্যে জাপানি প্রতিনিধিদল অন্তত সাতবার ওয়াশিংটনে গিয়ে আলোচনা করলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। ট্রাম্পও মেজাজ বদলেছেন—একসময় জাপানকে “দুর্ধর্ষ” বলে প্রশংসা করলেও এখন বলছেন, “জাপান সহযোগিতা করছে না।”
গত সপ্তাহে ট্রাম্প জাপানসহ ২৩টি দেশকে নতুন শুল্কের নোটিশ পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে ১৪টি দেশই এশিয়ার, যার বেশিরভাগই রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি। ট্রাম্প ইতোমধ্যে কানাডার ওপর ৩৫ শতাংশ এবং অন্য অংশীদারদের ওপর ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এমনকি মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি নিয়েও তিনি চিন্তিত নন বলে মন্তব্য করেছেন। আগামী ১ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন তিনি, এর মধ্যে দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সময়সীমা দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করলেও নতুন করে আলোচনার সুযোগও তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো উদীয়মান অর্থনীতিগুলো এখন সমাধান খুঁজতে আগ্রহী। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে ট্রান্সশিপমেন্টেও (অন্য দেশ হয়ে পণ্য রপ্তানি) শুল্ক আরোপ করেছে, যা এ অঞ্চলের দেশগুলোকেও জটিলতায় ফেলেছে।
এদিকে চুক্তির ভাষাগত অস্পষ্টতা ও শুল্কের শর্ত জটিল হওয়ায় অনেক দেশ প্রস্তুতি নিতে সময় চাইছে। উদাহরণ হিসেবে, ভিয়েতনামের সঙ্গে চুক্তির আওতায় ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য শুল্কের মধ্যে পড়লেও, সেটি চূড়ান্ত পণ্যের জন্য, না সব উপাদানের জন্য—তা পরিষ্কার নয়। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, সরবরাহকারী ও তৃতীয় পক্ষের সংশ্লিষ্টতার কারণে বাস্তবায়নেও সময় লাগবে বলে জানান সিঙ্গাপুরের গবেষক অ্যালেক্স ক্যাপরি।
ট্রাম্পের এই শুল্ক কৌশল থেকে স্পষ্ট যে এটি অস্থায়ী কোনো বিষয় নয়, বরং বৈশ্বিক বাণিজ্যের স্থিতিশীলতা এখন হুমকির মুখে। এর প্রভাব পড়ছে শুধু রপ্তানিকারকদের ওপর নয়, আমদানিকারক ও যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ ভোক্তারাও ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এশিয়ার যেসব দেশের অর্থনীতি রপ্তানি, ইলেকট্রনিকস, পোশাকশিল্প এবং নির্মাণসামগ্রীর ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য এটি বড় ধাক্কা। অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভারসাম্যহীন সম্পর্ক, যেমন জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে, এই শুল্ক যুদ্ধকে আরও জটিল করে তুলেছে।
জাপানের প্রেক্ষাপটে, দেশটি চাল সংকটে ভুগলেও মার্কিন চাল আমদানিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, নিজেদের কৃষকদের সুরক্ষার স্বার্থে। তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির দাবিও প্রত্যাখ্যান করেছে তারা। এপ্রিলেই ট্রাম্প শুল্ক আরোপ করলে পরদিনই জাপান জরুরি অবস্থা জারি করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সহায়তা কেন্দ্র চালু করে দেয়, যা তাদের প্রস্তুতির প্রমাণ। তবে আগস্টের মধ্যে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ জুলাইয়ে জাপানে সংসদের উচ্চকক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ট্রাম্প সময়সীমা বাড়িয়ে নিজের অবস্থান দুর্বল করে ফেলেছেন এবং চুক্তির কার্ড আগেই প্রকাশ করে ফেলেছেন। এই অবস্থায় চীন তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে চীনের পণ্য বাদ পড়লেও, তারা নিজেদের স্থিতিশীলতার ভাবমূর্তি তুলে ধরছে। তবে একদিকে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মূল চুক্তির সময়সীমা ১৩ আগস্ট পর্যন্ত নির্ধারিত, অন্যদিকে অনেক দেশ এখনো দ্বিধান্বিত—যুক্তরাষ্ট্র না চীন, কে হবে দীর্ঘমেয়াদি মিত্র?
সব মিলিয়ে, এ বাণিজ্যযুদ্ধ শুধু অর্থনীতিকে নয়, কূটনীতিক সম্পর্ককেও নাড়িয়ে দিচ্ছে। ‘কে জিতল, কে হারল’ এ বিশ্লেষণ দিয়ে এ যুদ্ধের শেষ বলা সম্ভব নয়, কারণ বৈশ্বিক বাণিজ্য কাঠামো বদলাতে শুরু করেছে, যার প্রভাব থাকবে বহু বছর ধরে।