ডলারের দরপতন ১৯৭৩ সালের পর সবচেয়ে বড়,বিশ্ববাজারে অস্থিরতা ও আস্থার সংকট

প্রতিবেদক: চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বৈশ্বিক মুদ্রাবাজারে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের যে ধস নেমেছে, তা ১৯৭৩ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি।

১৯৭৩ সালে স্বর্ণমান থেকে বেরিয়ে আসার পর ডলারের মান বড় ধরনের পতনের মুখে পড়েছিল। তবে এবারের পতনের পেছনে আছে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট—বিশ্বব্যবস্থার পুনর্গঠনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এককেন্দ্রিক ও শুল্কনির্ভর নীতিমালা।

ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রাসী শুল্কনীতি, মূল্যস্ফীতির আতঙ্ক এবং সরকারি ঋণের লাগামহীন বাড়তি চাপ—এই তিনটি কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ডলারের ওপর থেকে কমে যাচ্ছে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

এর প্রভাবে মার্কিন নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণের খরচ বেড়ে যাচ্ছে, আর বিদেশি বিনিয়োগও হ্রাস পাচ্ছে এমন সময়, যখন যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি ঋণ নিতে চাইছে। যদিও রপ্তানিকারকদের কিছুটা সুবিধা হয়েছে, তবু আমদানির খরচ বৃদ্ধি ডলারের পতনের নেতিবাচক দিকই তুলে ধরছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের হুমকি কিছুটা কমে এলেও ডলারের পতন অব্যাহত রয়েছে। মার্কিন শেয়ারবাজার এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ২৪ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু ডলারের দুর্বলতার কারণে ইউরোয় রূপান্তর করলে এই প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ১৫ শতাংশে।

ফলে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা এখন ইউরোপ ও অন্যান্য বাজারের দিকে ঝুঁকছেন। ইউরোপের ইউরোস্টক্স ৬০০ সূচক একই সময়ে ১৫ শতাংশ বেড়ে ডলারে রূপান্তর করলে তা ২৩ শতাংশ হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, বিনিয়োগকারীরা এখন মার্কিন সম্পদের বিকল্প খুঁজছেন। বিশেষত ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। মূল্যস্ফীতির আতঙ্ক, সুদের হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে মার্কিন অর্থনীতির বিশেষ অবস্থানটি এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

ফলে ডলার-নির্ভর ব্যবসা ও লেনদেন কমছে, বিশেষ করে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ সংগ্রহে সমস্যা তৈরি হতে পারে।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করে ও ডলারে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। এই পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। অনেক দেশ মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্র চাইলে তাদের সঙ্গেও একই আচরণ করতে পারে। এর ফলে ডলারবিমুখতা বা ডিডলারাইজেশন শুরু হয়েছে—অনেক দেশ এখন লেনদেনে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করছে।

যদিও সম্পূর্ণ ডিডলারাইজেশন এখনও সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তবে এটি যে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

অন্যদিকে মার্কিন সরকার ব্যয় বাড়াতে চাচ্ছে, যা ট্রাম্পের আগের প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী। কংগ্রেসে একটি বাজেট বিল প্রস্তাবিত হয়েছে, যা অনুমোদিত হলে আগামী এক দশকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘাটতি সৃষ্টি হবে। এই ঘাটতি পুষাতে আরও বেশি ঋণ নিতে হবে ট্রেজারি থেকে। কিন্তু যখনই ঋণদাতারা মার্কিন বাজার থেকে সরে যাচ্ছেন, তখন প্রশ্ন উঠছে—ট্রেজারি বন্ড ও ডলার আদৌ নিরাপদ বিনিয়োগ কি না।

ডলারের পতন শুধু একটি মুদ্রার দরপতন নয়; এটি বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, নেতৃত্ব, ও নীতির প্রতি আস্থার এক সূচক। ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত, ফেডের স্বাধীনতা নিয়ে চাপ, এবং বিশ্বে বিকল্প অর্থনৈতিক কাঠামোর উত্থান সবই মিলে ডলারের দুর্বলতাকে ঘনীভূত করছে।

বিশ্লেষক স্টিভ ইংল্যান্ডারের কথায়, “ডলার শক্তিশালী না দুর্বল, এটা আসল প্রশ্ন নয়—বিশ্ব ডলারের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রকে কীভাবে দেখছে, সেটিই মূল প্রশ্ন।