
প্রতিবেদক: দেশে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার পর প্রায় দুই মাস ধরে মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের সংকট অনেকটাই কমে এসেছে। এর ফলে ডলার নিয়ে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, সেটিও অনেকটা কেটে গেছে। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। এই অবস্থায় ডলারের দাম পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কিনে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। গত দুই দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৪৮ কোটি ডলার কিনেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বর্তমানে প্রতি ডলারের দাম ১২০ থেকে ১২৫ টাকার মধ্যে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। গত বুধবার ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলারের লেনদেন হয়েছে ১২০.৭০ থেকে ১২১.২০ টাকায়। এর আগের দিন ছিল ১২১.৫০ এবং ১২০.৮০ টাকা, আর সোমবার ছিল যথাক্রমে ১২০.১০ ও ১১৯.৫০ টাকা। গত জুনের শুরুতে এই দর ছিল ১২২.৮০ থেকে ১২৩ টাকা। অর্থাৎ, সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ডলারের দামে বড় ধরনের উত্থান-পতন ঘটেনি।
বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বাজারে ডলারের সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ায় এখন আমদানি বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার সময় এসেছে। বিলাসবহুল পণ্যের আমদানিতে যে বাড়তি শর্ত আরোপ করা হয়েছিল, সেগুলোও এখন শিথিল করা দরকার। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসবে।
বাংলাদেশে ডলারের দাম নির্ধারিত হয় মূলত প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের উপর ভিত্তি করে। যখন রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে, তখন ডলারের দাম কমে এবং কমলে দাম বাড়ে। সরকার পরিবর্তনের পর অর্থ পাচার কমে এসেছে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু কার্যকরী পদক্ষেপের ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন প্রতিমাসে প্রায় ২০০ কোটির বেশি ডলার আসছে। গত মার্চে এ পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলার কেনার প্রতিযোগিতা কমে গেছে এবং রেমিট্যান্সের দরও কমে এসেছে—যেখানে আগে ১২৩ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হতো, এখন তা ১২১ টাকায় নেমেছে।
এমটিবি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, এখন ডলারের বাজার স্বাভাবিক রয়েছে। সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার কেনা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ভালো উদ্যোগ। তবে আমদানিতে গতি আসলে ডলারের মজুত পরিস্থিতি কেমন থাকে, সেটি গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।
ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে বাজারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এই আয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ বা প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৩০.৩২ বিলিয়ন ডলার, যেখানে আগের বছর তা ছিল ২৩.৯১ বিলিয়ন। একই সময়ে রপ্তানি আয় ৪৮.২৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছর ছিল ৪৪.৪৭ বিলিয়ন।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে এবং চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে এসেছে। এর ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে এবং আমদানি-জনিত মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বাজারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণের পর ব্যাংকগুলো এখন আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ডলার লেনদেন করছে। এতে বাজারে স্থিতি ফিরেছে। ব্যাংকগুলো এখন রেমিট্যান্স কেনায় সাবধানী এবং কম দামে ডলার সংগ্রহ করছে, যার ফলে আমদানিকারকেরাও তুলনামূলকভাবে কম দামে ডলার পাচ্ছেন। আর উদ্বৃত্ত ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক কিনে নিচ্ছে, যার মাধ্যমে দামের অতিরিক্ত ওঠানামা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার ২২টি ব্যাংক থেকে নিলামের মাধ্যমে ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যার প্রতি ডলারের দাম ছিল ১২১.৫০ টাকা। এর আগে রোববার ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার কেনা হয়। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বকেয়া আমদানির দায় মিটে যাওয়ায় এখন ডলারের চাহিদা কমে গেছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বেড়ে যাওয়ায় ডলারের সরবরাহও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বাজার স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।