
প্রতিবেদক: ২০২২ সালের শুরু থেকে দেশে মার্কিন ডলারের সংকট শুরু হলে সরকার আমদানি নিরুৎসাহিত করার নানা পদক্ষেপ নেয়। পণ্য আমদানিতে শতভাগ পর্যন্ত নগদ মার্জিন আরোপ, বাড়তি শুল্ক বসানো ও ব্যাংকঋণ সীমিত করার কারণে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আসে। মার্জিন আরোপের ফলে আমদানিকারকদের নিজেদের উৎস থেকে পুরো অর্থ সরবরাহ করতে হয়, যা আমদানিকে ব্যয়বহুল ও কঠিন করে তোলে। ফলে আমদানি খাতে বড় রকমের সঙ্কোচন ঘটে।
২০২৩ সালের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সংকট নিরসনে মুদ্রাবাজারে সংস্কার আনা হয়, যার আওতায় ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এই উদ্যোগের ফলে ডলারের সরবরাহ বাড়ে, সংকট হ্রাস পায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে থাকে। ডলারের দামও কিছুটা কমে আসে। যদিও কিছু বিলাসপণ্যের ক্ষেত্রে এখনো আমদানি বিধিনিষেধ বহাল রয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০২১–২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯.১৬ বিলিয়ন ডলার, যেখানে আগের বছর তা ছিল ৬৫.৫৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কড়াকড়ি আরোপে ২০২২–২৩ অর্থবছরে তা কমে ৭৫.০৬ বিলিয়ন ডলারে এবং ২০২৩–২৪ অর্থবছরে আরও কমে ৬৬.৭৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। বিদায়ী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে আমদানিতে খরচ হয়েছে ৬৩.৯৬ বিলিয়ন ডলার।
বিদায়ী ২০২৪–২৫ অর্থবছরে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স উভয় খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। প্রবাসী আয় আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৬.৪ বিলিয়ন ডলার বা ২৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০.৩২ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ২০২৩–২৪ সালে তা ছিল ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি খাতেও ৮.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা রপ্তানি আয়কে ৪৮.২৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে এবং চলতি হিসাবের ঘাটতি অনেকটাই কমে এসেছে।
ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করায় ব্যাংকগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক মান অনুসারে নিয়মিত লেনদেন শুরু হয়। ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় এখন কম দামে কিনছে এবং ব্যবসায়ীদেরও ডলার আগের চেয়ে সহজে এবং কম দামে মিলছে। উদ্বৃত্ত ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে কিনে নিচ্ছে, যা ডলারের দামে অস্থিরতা ঠেকাতে সহায়তা করছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো ডলার ১২২ টাকার মধ্যে কেনাবেচা করছে।
তবে তিন বছর ধরে চলা সংকটের কারণে এখনো বেশ কিছু পণ্যে আমদানি বিধিনিষেধ বহাল রয়েছে। মোটরকার, ইলেকট্রনিকস, স্বর্ণালংকার, বিলাসপণ্য, প্রসাধনী, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও পানীয়, সফট ড্রিংকস, চকলেট, কফি, তামাকজাত পণ্যসহ অনেক পণ্যে শতভাগ নগদ মার্জিন দিতে হচ্ছে। এসব খাতে ব্যাংকঋণও বন্ধ রয়েছে। এলসি খোলার ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো এখনো সতর্ক আচরণ করছে।
ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, দেশের অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে হলে আমদানিতে আরোপিত বিধিনিষেধ শিথিল করা জরুরি। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে, নতুন বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসবে। সাবেক এবিবি চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, ডলার সংকট আপাতত কেটে গেছে এবং এখন সময় এসেছে সব বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক বার্তা দেবে।