
প্রতিবেদক: অনলাইনে ই-কমার্স ব্যবসার আড়ালে অন্তত ৭০০ কোটি টাকা পাচার করেছে আটটি প্রতিষ্ঠান। শত শত অনিবন্ধিত ই-কমার্স ও এফ-কমার্স প্রতিষ্ঠান নানা প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের সর্বস্বান্ত করছে। বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়লেও বাংলাদেশে এই খাত নিয়ে বাড়ছে অনাস্থা ও হতাশা।
বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উৎসবকেন্দ্রিক কেনাকাটাকে পুঁজি করে প্রতারক চক্র ই-কমার্স ও এফ-কমার্স ব্যবসার নামে গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এরপর সেই অর্থ মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি) মাধ্যমে সংগ্রহ করে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।
সিআইডির অনুসন্ধান অনুযায়ী, আটটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মোট ৭০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। এর মধ্যে ‘আনন্দের বাজার’ ৩০০ কোটি, ‘ই-অরেঞ্জ’ ২৩২ কোটি, ‘ধামাকা’ ১১৬ কোটি, ‘রিং আইডি’ ৩৭.৪৯ কোটি, ‘টোয়েন্টি ফোর টিকিট লিমিটেড’ ৪.৪৪ কোটি, ‘এসপিসি ওয়ার্ল্ড’ ১.১৭ কোটি, ‘সিরাজগঞ্জ শপ’ ৪.০৯ কোটি এবং ‘আকাশনীল ডটকম’ ৩ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশে প্রায় ১০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে এক কোটি মানুষ ই-কমার্সের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা গ্রহণ করে থাকেন। বর্তমানে আনুমানিক সাড়ে তিন লাখ ফেসবুক পেজ এফ-কমার্স ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু এর মধ্যে ‘ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেমে’ (ডিবিআইডি) নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ১,৪৯৬। অর্থাৎ নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের হার মাত্র ০.৫০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে ই-কমার্স খাতে বৈধভাবে লেনদেন হয়েছে ৫,১৪২ কোটি টাকার। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১,১১২ কোটি টাকায়। তবে এই বিশাল অঙ্কের লেনদেনের বেশির ভাগই অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হচ্ছে, যার ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এই প্রতারণাগুলো সাধারণত একটি নির্দিষ্ট কৌশল অনুযায়ী চলে। প্রথমে ফেসবুকে একটি পেজ খোলা হয় অথবা ব্যক্তিগত আইডি থেকেই ভুয়া রিভিউ, কৃত্রিম লাইক-কমেন্ট তৈরি করে জনপ্রিয়তার আভাস দেওয়া হয়। তারপর জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের ছবি বা কণ্ঠস্বর অবৈধভাবে ব্যবহার করে প্রমোশনাল কনটেন্ট তৈরি করা হয়। এসব দেখে আকৃষ্ট হয় গ্রাহকরা। পরে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হয় এবং নিম্নমানের বা ভিন্ন পণ্য পাঠিয়ে প্রতারণা করা হয়। অনেক সময় পণ্যের পুরো টাকা অগ্রিম নিয়েও পণ্য পাঠানো হয় না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই নিজের নামে কোনো এমএফএস একাউন্ট ব্যবহার না করে স্থানীয় এজেন্টদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ক্যাশআউট করে। এতে করে গ্রাহক টাকা দিলেও তা কোন ব্যক্তির কাছে গেল, সেটি শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এছাড়া মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর কিছু অসৎ কর্মকর্তার সহযোগিতায় অন্যের নামে বিকাশ রেজিস্ট্রেশন করে প্রতারকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ফলে সেই নম্বর ও এনআইডির তথ্য বিশ্লেষণ করেও অপরাধী শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকম, আলেশামার্টসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এর আগেও একই ধরনের প্রতারণা করেছে। তারা অগ্রিম টাকা নিয়ে সুলভ মূল্যে পণ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরবর্তীতে গ্রাহকদের ঠকিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালে একটি সার্কুলারে নির্দেশ দেয়, পণ্য গ্রাহকের হাতে পৌঁছানোর আগে পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের অর্থ আটকে রাখবে। তবে এখনো অনেক গ্রাহক আটকে পড়া অর্থ ফেরত পাননি।
স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, সব ধরনের অনলাইন ব্যবসা (ই-কমার্স ও এফ-কমার্স) বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধনের আওতায় আনা, ব্যবসায়িক পেজে নিবন্ধনের সনদ প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতা, সময়োপযোগী পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল কমার্স আইন প্রণয়ন এবং এসক্রো সার্ভিস চালুর মাধ্যমে পেমেন্ট নিরাপদ করা।
তাছাড়া নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের জন্য মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সার্ভিস চার্জ কমানো, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার ঠেকাতে নজরদারি বৃদ্ধি এবং বিটিআরসির মাধ্যমে মেটা করপোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও সুপারিশ করা হয়।