
প্রতিবেদক: অনেকটা যেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতার সেই পত্রবাহক। তবে এই রানারের কাঁধে চিঠিপত্র নয়, আছে খাবারের প্যাকেট। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নগর জীবনে যুক্ত হয়েছে অনলাইন খাবার সরবরাহের নতুন ধারা। রেস্তোরাঁ থেকে খাবার এখন সরাসরি চলে আসছে গ্রাহকের ডাইনিং টেবিলে। আর এই পরিষেবার অন্যতম চালিকাশক্তি হলেন ডেলিভারি রাইডাররা।
ঢাকার অলিগলি পেরিয়ে অক্লান্তভাবে বাইসাইকেল চালিয়ে খাবার পৌঁছে দেন আবদুল কাদের। গোলাপি রঙের ফুডপান্ডা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তিনি পেরিয়ে যান যানজট, খানা-খন্দ ও প্রতিকূল আবহাওয়ার বাধা। গ্রীষ্মের রোদ, বর্ষার ফোঁটা বা ঝড়ো রাত—কোনোটাই তাকে থামাতে পারে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী কাদেরের জীবনে প্রতিটি ডেলিভারি মানে বেঁচে থাকার লড়াই। ঢাকার শেওড়াপাড়া থেকে কাজীপাড়া হয়ে মিরপুর-১০ ও মিরপুর-১১ অবধি তার পরিচিত এলাকা। নেত্রকোণার কৃষক পরিবারে বড় হওয়া এই ২২ বছর বয়সী তরুণ বলেন, নিজেদের জমি নেই। বাবা আর দুই ভাই অন্যের জমিতে চাষ করেন। কেউই লেখাপড়ার সুযোগ পাননি।
পরিবারে তিনিই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে ঢাকায় এসেছেন, থেকে যাচ্ছেন কাজীপাড়ার একটি মেসে। শহরের ব্যয়বহুল জীবনে বেঁচে থাকার সহজ পথ ছিল একটি চাকরি, তাই বন্ধুদের পরামর্শে শুরু করেন ফুড ডেলিভারির কাজ।
টিউশনির মতো খণ্ডকালীন চাকরির তুলনায় এই কাজের সবচেয়ে বড় সুবিধা—যেকোনো সময় কাজ করা যায়। ক্লাসের পর শুরু হয় তার ডেলিভারি শিফট। তবে কাজটি সহজ নয়। যানজট, খারাপ আবহাওয়া, ক্লান্তি এবং সময়মতো খাবার পৌঁছে দেওয়ার চাপ—সবই মোকাবিলা করতে হয়। দেরি হলে জরিমানা হয়, আবার গ্রাহকের বিরক্তিও নিতে হয়।
তবু কাদের এই কাজকে জীবন নয়, বরং স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি হিসেবে দেখেন। বলেন, “কঠিন হলেও এটি আমাকে ঢাকায় টিকে থাকতে ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করছে। যখনই পারি, কিছু টাকা বাড়িতেও পাঠাই।”
নীলফামারীর বাবলা ঢাকায় আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে। সুযোগ না পেয়ে ভর্তি হন সরকারি তিতুমীর কলেজে। কিছু সঞ্চয় ও পরিবারের বিক্রি করা জিনিসপত্রের টাকাও শেষ হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে খুঁজতে থাকেন কাজ। পরিচিত না থাকলে টিউশনিও মেলে না। তাই ২০২3 সালের ডিসেম্বরে শুরু করেন ফুডপান্ডায় পার্টটাইম কাজ।
প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে সপ্তাহে আয় করেন প্রায় ২২০০-২৩০০ টাকা। ভালো কাজ করলে বোনাসও মেলে। একবার নিজের নির্ধারিত জোনের বাইরে টিকাটুলিতে খাবার পৌঁছে দিয়েছিলেন কেবল দায়বদ্ধতার জন্য।
কাদের বা বাবলার মতো হাজারো তরুণ আজ গিগ অর্থনীতির অংশ। মূলত গ্রামীণ পটভূমি ও নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীরাই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে এই কাজে যুক্ত হচ্ছেন। ফুডপান্ডা, পাঠাও, ফুডি ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে।
তবে আয় তুলনামূলকভাবে কম। মাসিক ১৫-২০ হাজার টাকায় চলে না ভবিষ্যতের সংসার। এরপরও ছাত্রজীবনের খরচ চালানো ও বাড়িতে সহায়তা করার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন।
ডিজিটাল উদ্ভাবন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিস্তার এবং মানুষের পছন্দের পরিবর্তনের কারণে অনলাইন ফুড ডেলিভারি খাত দ্রুত বাড়ছে। প্রতিদিন ছয় কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হচ্ছে।
তবু এ খাতে রয়েছে অস্থিরতা। উবার ইটস, সহজ ফুড, হাংরিনাকি ও ই-ফুডের মতো অনেক প্ল্যাটফর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় ফুডপান্ডা। দেশের ৫০টিরও বেশি শহরে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং তাদের সঙ্গে আছে এক লাখের বেশি রাইডার।
ফুডির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মাসরুর হাসান মিম বলেন, “খাতটির বড় সংকট রাইডার সংকট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম।” পাঠাওয়ের এমডি ফাহিম আহমেদ জানান, “আমরা নারী-পুরুষ সবার জন্য নিরাপদ ও দক্ষ কাঠামো তৈরি করতে কাজ করছি।”
রাইডাররা বলছেন—সব দোষ তাদের ঘাড়ে চাপানো হয়। সময়মতো খাবার পৌঁছানো না গেলে গ্রাহক ক্ষিপ্ত হন, টিপস আটকে দেন, এমনকি গালিগালাজও করেন। অথচ দেরির পেছনে অনেক সময় রেস্তোরাঁর গাফিলতি বা যানজট দায়ী।
মিরপুরের বাসিন্দা সাইফ হাসনাত বলেন, “গরম খাবার পলিথিনে এনে দেওয়া একেবারেই নিরাপদ নয়।” মোহাম্মদপুরের আল আমিন হোসেন মনে করেন, “রাইডার কম থাকায় বিশাল এলাকায় খাবার পৌঁছে দিতে হয়, তাই দেরি হয়।”
গিগ ইকোনমিতে যুক্ত কর্মীরা এখনো ‘স্বাধীন উদ্যোক্তা’ হিসেবে বিবেচিত। তারা শ্রম আইনের আওতায় পড়েন না। ফলে নেই বেতনভুক্ত কর্মচারীর সুবিধা—ন্যূনতম মজুরি, ওভারটাইম, মাতৃত্বকালীন ছুটি, বিমা বা দুর্ঘটনা সুরক্ষা।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (RAPID)-এর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, “এই খাত ক্রমেই জনপ্রিয় হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়। খাবারের নিরাপত্তা ও সেবার মান নিশ্চিত করতে নীতিগত কাঠামো দরকার।
ডাটাসেন্সের প্রধান কল্পনাকারী অনন্য রায়হান বলেন, “আইনি স্বীকৃতির অভাবে গিগ কর্মীরা স্বাস্থ্যঝুঁকি, আর্থিক অনিশ্চয়তা ও শোষণের শিকার হচ্ছেন।
স্বপ্ন নিয়ে শহরে আসা তরুণদের জীবনসংগ্রামে অনলাইন ফুড ডেলিভারির এই কাজ শুধু একটি চাকরি নয়, বরং একটি সম্ভাবনার পথ। তবে এ সম্ভাবনাকে টেকসই করতে হলে গিগ কর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ও ন্যায্য সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। না হলে এই ‘রানার’দের জীবনে থাকবে শুধু ছুটে চলা—গন্তব্যের দেখা না মিলেই।