দর-কষাকষিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ, সময় মাত্র ১০ দিন

প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কমানো নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দর–কষাকষা চলছে। তবে এই আলোচনায় শুরু থেকেই বেসরকারি খাত, অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকদের সম্পৃক্ত না করায় এখন আলোচনার ফল নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের মতে, আলোচনা অগ্রগতিহীন এবং এর ফল ভোগ করতে হবে দেশের রপ্তানিকারকদের।

একাধিক বড় ক্রেতা ইতিমধ্যে বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের জানিয়েছে, দেশটি দর–কষাকষায় অনেক পিছিয়ে আছে। ফলে নতুন শুল্কহার কার্যকর হলে দেশের রপ্তানিখাত বড় বিপদের মুখে পড়বে। শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, “৪০ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে রপ্তানিখাতে এমন সংকট দেখিনি। আমাদের অবস্থান দুর্বল।

গত এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের (USTR) সঙ্গে আলোচনা শুরু করে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রথম দুই দফা আলোচনায় কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। অথচ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগে এখন সময় আছে মাত্র ১০ দিন।

প্রথমে আলোচনার দায়িত্বে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক দূত লুৎফে সিদ্দিকী, পরে যুক্ত হন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। পরে নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। আলোচনায় গতি আনতে সরকারের পক্ষ থেকে লবিস্ট নিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করা হয় মাত্র দুই দিন আগে, যখন সময় প্রায় শেষ।

ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, “নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (NDA)” এর অজুহাতে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা সংক্রান্ত কোনো তথ্য জানানো হয়নি। ফলে রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীরা পুরো সময়টা অন্ধকারে ছিলেন।

এক শীর্ষ ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে বলেন, “শুরুর সময় থেকেই আমরা অনুরোধ করেছিলাম লবিস্ট নিয়োগ ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হোক। সরকার তখন আমাদের আশ্বস্ত করেছিল, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে। এখন এসে আমাদের দ্বারস্থ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি গন্তব্য। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৮৬৯ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক, বাকি অংশে রয়েছে টুপি, চামড়ার জুতা, হোম টেক্সটাইল, পরচুলা ইত্যাদি।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক কার্যকর হলে গড় শুল্কহার দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে, যা বাংলাদেশের রপ্তানিকে কার্যত অপ্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।

বিজিএমইএ মাত্র দুই দিন আগে সরকারের কাছ থেকে সবুজসংকেত পেয়ে দুইটি লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে—সিজিসিএন গ্রুপ ও বলার্ড পার্টনার্স। বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “এত দেরিতে শুরু করায় ভালো লবিস্ট পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে অন্য দেশের হয়ে কাজ করছে।”

এছাড়া বাংলাদেশের গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (PRI)–কেও দর–কষাকষার কাজে যুক্ত করার চেষ্টা করছে বিজিএমইএ। তবে এখনো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে কোনো নির্দিষ্ট বৈঠকের তারিখ পাওয়া যায়নি।

ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র কেবল বাণিজ্য নয়, ভূরাজনৈতিক কৌশলগত স্বার্থেও বাংলাদেশকে কাছে টানতে চায়। এর আওতায় শর্ত রয়েছে—যদি যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা দেয়, বাংলাদেশকেও তা মানতে হবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে বাংলাদেশ, তা অন্য কোনো দেশকে দেওয়া যাবে না—এমন শর্তও আলোচনায় এসেছে বলে জানা গেছে।

অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কমানোর আলোচনায় আমরা কূটনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়েছি। তবে এখনো ১০ দিন আছে—সরকারপ্রধানের সব ধরনের যোগাযোগের উৎস কাজে লাগিয়ে শেষবারের মতো চেষ্টা করা উচিত। না হলে, এই শুল্কের ধাক্কায় ১০ লাখ মানুষ চাকরি হারাতে পারেন।”

বাংলাদেশ সময় হারালেও সুযোগ হারায়নি—এখনো ১০ দিন সময় আছে। তবে শর্ত হচ্ছে: দ্রুত সিদ্ধান্ত, সর্বাত্মক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে একটা সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া। তা না হলে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক-সংকট হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানিখাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।