
প্রতিবেদক: নিকিতা ক্রুশ্চেভ একবার বলেছিলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা সর্বত্রই এক। তাঁরা সব সময় সেতু তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দেন, যদিও সেখানে কোনো নদীই নেই।বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উক্তিটি পুরোপুরি খাটে না। এখানে নদী ছিল, সেই নদীতে সেতু তৈরির প্রতিশ্রুতিও ছিল। তবে ছিল না কেবল বিশ্বাস। অবিশ্বাসের পেছনে কারণও ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণ হলেও এর পেছনের বহু ঘটনা অজানাই থেকে গেছে।
সম্প্রতি প্রথম আলোর করা এক প্রতিবেদনে এই সব তথ্য উঠে আসে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়। যদিও ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একনেক সভায় প্রথম প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়। বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তা স্থগিত করে দেয়।
মূল সমস্যা তৈরি হয় পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে। বিশ্বব্যাংকের তদন্তে উঠে আসে, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন সাকো ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ঘুষ ও কমিশনের দাবি করা হয়। ঠিকাদারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। বিশ্বব্যাংক স্পষ্ট জানায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে অর্থায়ন বন্ধ থাকবে।
সরকার শুরুতে কিছু কর্মকর্তা বদল করলেও মন্ত্রীকে পদে বহাল রাখে। আন্তর্জাতিক তদন্তে আরও দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। একাধিকবার বিশ্বব্যাংক প্রমাণ ও চিঠি পাঠালে শেষমেশ সরকার মন্ত্রিত্বে রদবদল আনে। যদিও দুদক জানায়, মন্ত্রী দুর্নীতিতে জড়িত নন, বিশ্বব্যাংক তাদের তদন্তে ভিন্ন দাবি তোলে। শেষ পর্যন্ত সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
২০১২ সালে কানাডার এসএনসি-লাভালিনকে পরামর্শক নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করে। পরে ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় মামলা করে দুদক। মামলায় সাতজনকে আসামি করা হয়, যাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। তাঁকে গ্রেপ্তার ও সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় চাকরিতে ফিরে আসেন।
২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর আদালত দুদকের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতি দেয়। দুদক ওই প্রতিবেদনে জানায়, দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলছেন, অনিয়মের যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ‘গায়ের জোরে’ মামলা বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই মামলাটি আবারও নতুন করে তদন্ত করা হচ্ছে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছিল, এসএনসি-লাভালিনকে ঘুষ দিয়ে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগ পাইয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, সচিব নিজের মতো করে কমিটি গঠন করেন, গোপনে দরপত্র ফাঁস করেন এবং টেন্ডার মূল্যায়নে ইচ্ছাকৃতভাবে নম্বর কেটে অন্যদের বাদ দিয়ে এসএনসি-লাভালিনকে সুবিধা দেন। রমেশ শাহর ডায়েরিতে ঘুষ বণ্টনের তালিকাও পাওয়া যায়, যেখানে সচিবের নাম রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কয়েকবার কমিটি গঠন-বিলুপ্তির পর সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া নিজেকে আহ্বায়ক করে চতুর্থ কমিটি গঠন করেন। অথচ বিশ্বব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী কমিটির সদস্যদের কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এরপরও তিনি কাজী মো. ফেরদাউসকে সদস্যসচিব করেন, যিনি এসএনসি-লাভালিনের প্রতিনিধির সঙ্গে গোপন যোগাযোগে ছিলেন। তিনি দরপত্র সংক্রান্ত গোপন তথ্য ফাঁস করেন এবং বন্ধু রিয়াজ আহমেদের সহযোগিতায় আরএফপি ই-মেইলে পাঠান।
জাপানি কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দিতে না পেরে তাঁরা এসএনসি-লাভালিনকে সুবিধা দেওয়ার অপপ্রয়াস চালান। কমিটির অধিকাংশ সদস্যের বিরোধিতার পরও তাঁরা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যান। একপর্যায়ে সচিব একতরফাভাবে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিয়ে আরেকটি কমিটি গঠন করেন এবং বিশ্বব্যাংকের সুপারিশের অজুহাতে এসএনসি-লাভালিনকে সুপারিশ পাঠানো হয়।
জব্দকৃত ই-মেইল ও ডায়েরি থেকে দেখা যায়, ঘুষ ও সুবিধা পাওয়ার পরিকল্পনা ছিল স্পষ্ট। এমনকি কী পরিমাণ কমিশন দেওয়া হবে—তা-ও নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল। রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা ঢাকায় এসে সচিব, মন্ত্রীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও করেন।
এসব সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কিছু সরকারি কর্মকর্তা ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তবে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের চাপ ও গড়িমসিতে মামলা আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে মামলাটি আবারও চালু হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির সুযোগ তৈরি হয়েছে।