দুবাইয়ে বাংলাদেশি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অঢেল সম্পত্তি

অনলাইন ডেক্স:দুবাইয়ের ঝলমলে শহর, ব্যস্ততম এলাকা থেকে মরুভূমির শান্ত প্রান্তর পর্যন্ত, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের ধনীদের জন্য ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে পরিচিত।

দুবাইয়ের দ্রুত বর্ধনশীল আবাসন খাত বাংলাদেশিদের কাছে সম্পদ গচ্ছিত রাখার উপযোগী জায়গা হিসেবে জনপ্রিয়। এর মূল কারণ হলো নগদ অর্থে সম্পত্তি কেনার সুবিধা। শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোও নগদ অর্থে সম্পত্তি বিক্রির সুযোগ দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বারবারই দুবাইকে হুন্ডি লেনদেনের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো, বিপুল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক ও ধনাঢ্য বাংলাদেশির অবস্থান।

দুবাইয়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার ডলার (প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা) বিনিয়োগ করলে ‘গোল্ডেন ভিসা’ পাওয়া যায়। দুবাই ভূমি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রিয়েল এস্টেটে ২০ লাখ আরব আমিরাত দিরহাম বা তার বেশি মূল্যের সম্পত্তি কিনলে ১০ বছরের নবায়নযোগ্য রেসিডেন্স পারমিটের জন্য আবেদন করা যায়। এ ভিসায় স্বামী-স্ত্রী, সন্তান এবং পিতামাতাকেও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তবে বন্ধক থাকা সম্পত্তির ক্ষেত্রে ২০ লাখ দিরহাম পরিশোধের ব্যাংক চিঠি জমা দিতে হয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্যাক্স অবজারভেটরির ২০২১ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন অফশোর সম্পত্তির মূল্য প্রায় ২৬ কোটি ডলার (প্রায় ৩,১১৪ কোটি টাকা)। বিনিয়োগের পরিমাণ অনুযায়ী ‘সেকেন্ড হোম হিসেবে সিঙ্গাপুরের পর দুবাই বাংলাদেশিদের দ্বিতীয় পছন্দ।

তবে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (C4ADS) মতে, এই বিনিয়োগের পরিমাণ আরও দ্বিগুণ হতে পারে। সংস্থাটি দুবাই ভূমি বিভাগের ২০২০ ও ২০২২ সালের রেকর্ড এবং ইউটিলিটি কোম্পানির তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি ডেটাসেট তৈরি করে। এটি ২০২৪ সালের শুরুর দিকে প্রকাশিত দুবাই আনলকড শীর্ষক বৈশ্বিক তদন্তে ব্যবহার করা হয়। যদিও এতে বাংলাদেশের বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।

দুবাইয়ে ৪৬১ জন বাংলাদেশির নামে ৯২৯টি সম্পত্তি নিবন্ধিত রয়েছে। এর মধ্যে ২৫৯টি সম্পত্তি রাজনীতিবিদ, বড় ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের নামে নিবন্ধিত।

২০২০ ও ২০২২ সালের ডেটা ব্যবহার করে এই তথ্য সংগ্রহ করেছে সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ । তবে উল্লেখ করা হয়েছে, মালিকদের মধ্যে কেউ ইতিমধ্যে কিছু সম্পত্তি বিক্রি করেছেন বা নতুন সম্পত্তি কিনেছেন।

২০২৪ সালের আগস্টে ডেটাবেসের অ্যাক্সেস পাওয়ার পর বিশ্লেষণ চালানো হয়। ভূমি রেকর্ড থেকে প্রাপ্ত ৯২৯টি সম্পত্তির মধ্যে ২৭১টি সম্পত্তির সরাসরি মূল্য বিশ্লেষণ করা হয়। এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, পুরো ৯২৯টি সম্পত্তির মোট মূল্য ৪০ কোটি ডলার (প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।

দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের এই বিশাল বিনিয়োগ দেশের বাইরে সম্পদ গচ্ছিত রাখার প্রবণতার দিকটি ইঙ্গিত করে। এছাড়া রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সম্পত্তির উল্লেখযোগ্য অংশ থাকাও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

দুবাইয়ের ভূমি বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৯ জন ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে ৮২টি সম্পত্তি শনাক্ত করা হয়েছে। এ তথ্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যাচাই করা হয়েছে।

সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের ডেটাবেস থেকে তথ্য পাওয়ার পাঁচ মাস পর, “দুবাই আনলকড” প্রকল্পের অধীনে এসব সম্পত্তির কর, সেবা চার্জ ও অন্যান্য নথি যাচাই করা হয়। এ ছাড়া, একটি সম্পত্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

এই ১৯ জনের তালিকায় রয়েছেন—

  • সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ: সাবেক ভূমিমন্ত্রী
  • এইচবিএম ইকবাল: ঢাকা-১০ আসনের সাবেক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য
  • মোসাদ্দেক আলী ফালু: ঢাকা-১০ আসনের সাবেক বিএনপি সংসদ সদস্য
  • জিসান মির্জা: সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের স্ত্রী
  • নাফিজ সরাফাত: ব্যবসায়ী
  • সায়েম সোবহান আনভীর সাফওয়ান সোবহান তাসবীর: বসুন্ধরা গ্রুপের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব
  • মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম: ওরিয়ন গ্রুপের মালিক
  • আজিজ আল কাইসার আজিজ আল মাসুদ: পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এমএ হাশেমের দুই ছেলে
  • শাহাব সাত্তার তাসবীরুল আহমেদ চৌধুরী: বন্ধ হয়ে যাওয়া জিএমজি ও ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের মালিক বা প্রধান
  • শাহাব সাত্তার ও তাসবীরুল আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৭৮৫ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে, যা বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে।
  • অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ঋণখেলাপি ও আর্থিক অনিয়মের মামলা রয়েছে।
  • কয়েকজন ইতিমধ্যে আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন, তবে তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া চলমান।

দুবাইয়ের এসব সম্পত্তি কেনার অর্থের উৎস নিশ্চিত করা যায়নি।বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের প্রমাণ মেলেনি, তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।বাংলাদেশের মুদ্রা নীতি অনুযায়ী, দেশ থেকে মূলধন স্থানান্তর নিষিদ্ধ। তবে দ্বৈত নাগরিকত্ব বা বৈদেশিক আয় থাকলে বৈধভাবে সম্পত্তি কেনা যায়, যা আয়কর নথিতে ঘোষণা করতে হয়।

দুবাইয়ে বাংলাদেশি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পত্তি নিয়ে গবেষণার তথ্য আরও গভীর পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এ বিষয়ে আরও তদন্তের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।

দুবাই ভূমি বিভাগের সরকারি রেকর্ড এবং প্রতি বর্গফুটের গড় মূল্যের ভিত্তিতে প্রাক্কলন করা হয়েছে যে ১৯ জন ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের মালিকানাধীন ৮২টি সম্পত্তির মোট মূল্য প্রায় ২৯ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা)।

কিছু সম্পত্তি পরিবারের সদস্য বা অন্যান্য একাধিক সুবিধাভোগীর নামে নিবন্ধিত।কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি, কারণ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

 

সূত্র অনুযায়ী, এখনো এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এসব সম্পত্তি বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় কেনা হয়েছে।২০২৪ সালের নভেম্বরে ১৯ জনের মধ্যে ১৮ জনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে।মাত্র পাঁচজন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।কেউ বলেছেন, বৈধভাবে বিদেশে আয়ের মাধ্যমে এসব সম্পত্তি কিনেছেন।কেউ মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, কারণ তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান।

এদের সম্পত্তিগুলো দুবাইয়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এলাকায় অবস্থিত, যেমন—

  • বুর্জ খলিফা সংলগ্ন এলাকা: দুবাইয়ের আইকনিক ল্যান্ডমার্ক।
  • মার্সা দুবাই একটি অভিজাত আবাসিক ও বিনোদন এলাকা।
  • বিজনেস বে দুবাইয়ের অর্থনৈতিক জেলা।
  • পাম জুমেইরা পারস্য উপসাগরের বিলাসবহুল কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ।

বুর্জ খলিফা টাওয়ারে দুজন বাংলাদেশি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এর মধ্যে শুধু সায়েম সোবহান আনভীরের নথি পাওয়া গেছে এবং তার নাম প্রকাশ করা হয়েছে।

পাম জুমেইরায় ২০ জন বাংলাদেশির মালিকানাধীন সম্পত্তি রয়েছে, যাদের মধ্যে ৮ জনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের মামলা রয়েছে।বুর্জ খলিফা এলাকায় অন্তত ৬১টি সম্পত্তি বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন।এর মধ্যে ২১টি চারজন ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত। চারজনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

দুবাইয়ের অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশি মালিকানাধীন সম্পত্তির তথ্য উন্মোচন দেশের আর্থিক লেনদেন ও বৈধতার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে। যদিও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পত্তি কেনার প্রমাণ মেলেনি, তবু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে।

 

সূত্রঃ দ্য ডেইলি ষ্টার