
প্রতিবেদক: কর্মসংস্থানের প্রধান চালিকা শক্তি হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগ বাড়লে উৎপাদন বাড়ে এবং সেই অনুপাতে কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে কর্মসংস্থান তৈরিতে দেশি ও বিদেশি—উভয় ধরনের বিনিয়োগই গুরুত্বপূর্ণ হলেও পরিসংখ্যান বলছে, দেশীয় বিনিয়োগের অবদান তুলনামূলকভাবে বেশি।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশীয় বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৪১৮ জনের। একই সময়ে ৮৯ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৩৯ হাজার ২৪৫ জনের। ২০২০-২১ সালে দেশীয় বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলারে, যার মাধ্যমে ১ লাখ ৬০ হাজার ১০০ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। অপরদিকে, ১০৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলার বিদেশি বিনিয়োগে কর্মসংস্থান হয় মাত্র ২০ হাজার ৬৮৬ জনের।
২০০৯-১০ থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে মোট ১০ হাজার ৫৭৫ কোটি ডলার স্থানীয় বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২৮ লাখ ১৭ হাজার ৯০২ জনের, যেখানে ৫ হাজার ৯৪৩ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৮৭৫ জনের। পরিসংখ্যান বলছে, দেশীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একজনের কর্মসংস্থান তৈরিতে গড়ে ৩৭ হাজার ৫২৮ ডলার প্রয়োজন হয়, আর বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় ৯৩ হাজার ৪২৮ ডলার। অর্থাৎ, বিদেশি বিনিয়োগে একই পরিমাণ কর্মসংস্থান করতে আড়াই গুণ বেশি অর্থ লাগে।
যদিও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশে অনেক সুবিধা দেওয়া হয়, বাস্তবে প্রত্যাশিত হারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭১ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দেশীয় বিনিয়োগের মুনাফা দেশে থেকেই পুনর্বিনিয়োগ হয় এবং দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়। অন্যদিকে, বিদেশি বিনিয়োগের মুনাফার বড় অংশই চলে যায় বিনিয়োগকারীর নিজ দেশে, ফলে স্থানীয় অর্থনীতিতে তাদের সংযোগ গভীর হয় না।
তবে বিদেশি বিনিয়োগেরও প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে উচ্চ প্রযুক্তি, কারিগরি দক্ষতা এবং ব্যবসায় প্রতিযোগিতা আসে। বিদেশি বিনিয়োগ অবকাঠামো উন্নয়নে যেমন অবদান রাখে, তেমনি স্থানীয় পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগও বাড়ায়, রপ্তানি বৃদ্ধি করে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করে। তবুও বিশ্বব্যাংকের আইএফসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাতে বিদেশি বিনিয়োগের হার ছিল মাত্র ০.৪ শতাংশ, যেখানে সামগ্রিক বিনিয়োগের হার প্রায় ৩০ শতাংশ।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ সমস্যা, অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য এবং উচ্চ করহার। দেশীয় উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেন, দেশের ব্যাংক ঋণের সুদহার অনেক বেশি, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কম সুদে বিদেশ থেকে অর্থ আনতে পারেন এবং সহজেই মুনাফা বাইরে নিয়ে যেতে পারেন। অন্যদিকে, স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগ করতে হলে বহু অনুমোদনের ধাপ পেরোতে হয়।
শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, দেশে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সমস্যা সমাধানে সেভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয় না। বিনিয়োগ সম্মেলনের পরপরই গ্যাসের দাম বাড়ানো এবং নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দেয়। তিনি উল্লেখ করেন, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে তাঁর নতুন কারখানার গ্যাস সংযোগ এখনো মেলেনি।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা যদি স্বস্তিতে না থাকেন, তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী হবেন না। বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদহার ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে বিনিয়োগে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বিনিয়োগকারীরা এখন গণতান্ত্রিক উত্তরণের রূপরেখা এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালার দিকেই তাকিয়ে আছেন। প্রতিশ্রুতি যতই দেওয়া হোক, বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে, সেটাই বিনিয়োগকারীদের জন্য আসল বিষয়।