
প্রতিবেদক: দেশের জাতীয় কৃষি মজুরি (দৈনিক ৬০০ টাকা) থেকেও কম পারিশ্রমিক পান প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষক। আর বাকি ৬০ শতাংশ কৃষক পান নির্ধারিত মজুরি বা তার চেয়েও বেশি। তবে মজুরির দিক থেকে অঞ্চলভেদে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘উৎপাদনশীল ও টেকসই কৃষি জরিপ ২০২৫’-এর ফলাফলে এই চিত্র উঠে এসেছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস মিলনায়তনে সোমবার বিকেলে জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়। দেশে প্রথমবারের মতো কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন পরিমাপে এ ধরনের জরিপ পরিচালিত হয়েছে।
জরিপ অনুযায়ী, দেশের বিভাগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে সিলেট ও খুলনার কৃষকেরা। সিলেটে ৬৩ শতাংশ এবং খুলনায় ৬০ শতাংশ কৃষক নির্ধারিত মজুরি পাচ্ছেন না। অন্যদিকে ময়মনসিংহ বিভাগে ৭৫ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে ৭৩ শতাংশ কৃষক নির্ধারিত মজুরি পান, যা সবচেয়ে বেশি। ঢাকায় এই হার ৬৭ শতাংশ। শহরের তুলনায় গ্রামে কৃষকেরা কম মজুরি পান। শহরাঞ্চলে যেখানে ৭৬ শতাংশ কৃষক যথাযথ মজুরি পান, গ্রামে সেই হার মাত্র ৫৯ শতাংশ।
জরিপে আরও দেখা যায়, দেশের ৭৯ শতাংশ কৃষিজমি গত তিন বছরে অন্তত এক বছর লাভজনকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ২১ শতাংশ জমি কোনো বছরেই লাভজনক ছিল না। শহরাঞ্চলে অলাভজনক জমির হার ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া দেশের প্রায় ৩১ শতাংশ কৃষিজমি এখনো কৃষিঋণ, ইনস্যুরেন্স বা একাধিক ফসল চাষের আওতায় আসেনি, ফলে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এসব জমি বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। শহরাঞ্চলে এই ঝুঁকিপূর্ণ জমির হার ৪৪ শতাংশ।
সার ও কীটনাশক ব্যবহারে কৃষকের মধ্যে নিরাপদ চর্চা এখনো যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়নি। জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৪৩ শতাংশ জমিতে সার ব্যবহারের কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। আর ৪৯ শতাংশ জমিতে কীটনাশক ব্যবহারে স্বাস্থ্য ও পরিবেশবান্ধব ১১টি পদ্ধতির একটিও মানা হয় না। এটি পরিবেশ ও কৃষকের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সেচ ব্যবস্থাপনাতেও ঘাটতি রয়েছে—১৮ শতাংশ জমিতে এখনো পর্যাপ্ত সেচের পানি পাওয়া যায় না।
সব মিলিয়ে দেশের ৫৭ শতাংশ কৃষিজমি এখনো টেকসই ব্যবস্থাপনার বাইরে রয়েছে বলে জরিপে জানানো হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার। তিনি বলেন, “এত দিন আমরা শুধু উৎপাদন বৃদ্ধির চিন্তা করতাম। এখন পরিবেশ, মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন উপকরণের সঠিক ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুবুল হক পাটওয়ারী বলেন, “জরিপে যেসব দিক উঠে এসেছে, সেগুলো পরবর্তী প্রকল্প পরিকল্পনার জন্য দিকনির্দেশক হবে। সারের ব্যবহার নিয়ে যে তথ্য এসেছে তা উদ্বেগজনক। আমাদের ইউরিয়াসহ অন্যান্য সার আমদানি করতে হয়। অথচ সেগুলো কম দামে কৃষকের কাছে বিক্রি করতে হয়। সার ব্যবহারে অনিয়ম এখনো বন্ধ হয়নি।” তিনি আরও জানান, সম্প্রতি চালু করা হয়েছে ‘খামারি অ্যাপস’, যেখানে জমি অনুযায়ী সঠিক ফসল ও সারের পরামর্শ পাওয়া যায়। তবে এটি এখনো কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়নি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী। তিনি বলেন, “এত দিন আমরা কৃষিকে সাদাচোখে দেখতাম, এখন টেকসই দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যৎ কৃষিনীতি প্রণয়নে এই জরিপ সহায়ক হবে।” সভায় উন্মুক্ত আলোচনা সঞ্চালনা করেন বিভাগের যুগ্ম সচিব দীপংকর রায়।