দ্রুত উৎপাদন ও উচ্চ ফলনশীল ‘সানশাইন’ আলু চাষে আশাবাদী কৃষকরা

অনলাইন ডেক্স: বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ফসল আলু। এটি সারাবছরই খাদ্যতালিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সম্প্রতি, আলুর নতুন একটি জাত ‘সানশাইন’ কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, যা মাত্র ৬০ দিনে উৎপাদিত হয় এবং বছরে দু’বার অনায়াসে চাষ করা যায়।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মনোনীত শ্রীমঙ্গলের কৃষক মো. নাজমুল হাসান জানান, “সানশাইন আলু বাজারে পাওয়া যায় না। এটি মূলত বীজ তৈরির জন্য চাষ করা হয় এবং বিএডিসির মাধ্যমে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। তবে অতিরিক্ত বড় আকারের আলুগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করি।”

তিনি আরও বলেন, “গতবছর এই আলু চাষে ভালো লাভ হয়েছিল। এবার ১১ কেয়ার (বিঘা) জমিতে চাষ করেছি। আশা করছি প্রায় ৮০০ মণ আলু পাবো। বড় আলুগুলো ৩৫-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি।

আলু চাষে বিঘা প্রতি প্রায় ৫৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে শ্রমিকদের মজুরি, সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য খরচ। এ বছর চাষে মোট প্রায় ছয় লাখ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, তবে তিনি আশাবাদী যে এবারও ভালো লাভ করবেন।

নাজমুল হাসান আক্ষেপ করে বলেন, “আমরা কৃষকরা আড়তদারদের (মধ্যস্বত্বভোগী) কাছে জিম্মি। যদি সরাসরি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে পারতাম, তাহলে ন্যায্য মূল্য পেতাম এবং কৃষকরা আরও লাভবান হতো। কৃষি বিভাগের উচিত এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া।

তিনি আরও জানান, “আমি বীজ উৎপাদন করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএডিসিকে দিই। তারা সরকার-নির্ধারিত ন্যায্য মূল্যে আলু সংগ্রহ করে।

বিএডিসির মৌলভীবাজারের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানান, “সানশাইন আলু বীজের প্রচারণার দায়িত্ব সরকারিভাবে আমাকে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে উত্তরবঙ্গের কৃষকরা এটি চাষে এগিয়ে আছে, তবে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে চাষ এখনও কম।

তিনি কৃষকদের উৎসাহিত করতে বলেন, “যদি একবার সানশাইন আলু বীজ নিয়ে চাষ করেন, তাহলে অন্য কোনো বীজ নিতে চাইবেন না। কারণ এটি দ্রুত সেদ্ধ হয় এবং খেতেও সুস্বাদু।”

সানশাইন আলুর চাহিদা প্রতি বছর বাড়ছে বলে জানান তিনি। তার মতে, কৃষকরা এখনো ডায়মন্ড আলুবীজের প্রতি বেশি আগ্রহী, তবে ধীরে ধীরে সানশাইন আলুর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।

সানশাইন আলুর উচ্চ ফলন, দ্রুত উৎপাদন এবং স্বল্প সময়ে সেদ্ধ হওয়ার গুণ কৃষকদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে। তবে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো এবং সরাসরি কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করাই হবে কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নের বড় চ্যালেঞ্জ।

সানশাইন আলুর অন্যতম বড় সুবিধা হলো এর দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ ক্ষমতা ও বার্ষিক দুইবার উৎপাদনের সম্ভাবনা। এই আলুবীজ ২.২ থেকে ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় হিমাগারে অনির্দিষ্টকালের জন্য সংরক্ষণ করা সম্ভব। তবে সাধারণত এক মৌসুমের বীজ পরবর্তী মৌসুমে বিক্রি করা হয়। প্রতি বছর উৎপাদিত আলুবীজ কৃষকরা অক্টোবরের শেষ দিকে থেকে কিনতে শুরু করেন এবং নভেম্বরের দিকে বেশি পরিমাণে সংগ্রহ করেন।

সানশাইন আলুর আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো বছরে দুইবার চাষ করা সম্ভব। কারণ, এই আলু মাত্র ৬০ দিনে ফলন দেয়।

অক্টোবরের মাঝামাঝিতে রোপণ করলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে উত্তোলন করা সম্ভব।আবার ডিসেম্বরে রোপণ করলে ফেব্রুয়ারিতে উত্তোলন করা যায়।

এভাবে আগাম লাগানো হলে কৃষকরা উচ্চমূল্যে বিক্রি করতে পারেন, যা তাদের লাভের পরিমাণ বাড়ায়।

তবে সানশাইন আলুর একটি সমস্যা রয়েছে—প্রাথমিক পর্যায়ে গজাতে একটু বেশি সময় নেয়। এই সময় কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়েন, কারণ গাছগুলো প্রথমে লিকলিকে দেখায়। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই আলুগুলো বড় হতে শুরু করে এবং মাটির নিচে প্রচুর পরিমাণে আলু উৎপাদিত হয়। কৃষকদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে, কারণ শেষ পর্যন্ত এটি ভালো ফলন দেয়।

বর্তমানে কৃষকরা জমি থেকে যেসব আলু সংগ্রহ করছেন, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বাজারে নিলে কম দাম পাওয়া যেতে পারে। তবে যারা দুই থেকে চার মাস ঘরে সংরক্ষণ করে বাজারে নেন, তারা তুলনামূলক ভালো দাম পান।

সানশাইন আলুর আরেকটি সুবিধা হলো এটি চার থেকে পাঁচ মাস অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়, এমনকি হিমাগার ছাড়াই। তাই কৃষকরা যদি অপেক্ষা করেন, তাহলে বেশি লাভবান হতে পারেন।

সঠিক সময়ে রোপণ, সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণের কৌশল অনুসরণ করলে সানশাইন আলু চাষ কৃষকদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক হয়ে উঠতে পারে। ধৈর্য ধরে উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলে এবং উপযুক্ত সময়ে বাজারে আনলে কৃষকরা ভালো দামে বিক্রি করতে পারবেন, যা তাদের অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী করবে।