ধনীরা এখন পণ্যের চেয়ে অভিজ্ঞতায় খরচ করছেন

প্রতিবেদক: শ্যাতো দ’ইকেম ২০১০—কারও কাছে এটি কেবল মদের বোতল নয়, বিলাসিতার প্রতীক। এতে থাকে খুবানি, বাদাম, লেবুর খোসা, সাদা ট্রাফলসহ নানা স্বাদের সমাহার। বহু বছর ধরেই এই সেরা মিষ্টি ওয়াইনের দাম বেড়েছে। ২০২৩ সালে এসে এর দাম ছিল ২০১০–এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। শুধু ওয়াইন নয়, পুরোনো গাড়ি, হুইস্কি বা অট্টালিকা—সবকিছুর দাম উঠছিল। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নাইট ফ্রাঙ্কের ‘লাক্সারি ইনভেস্টমেন্ট ইনডেক্স’ বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ।

কিন্তু হঠাৎ করেই চিত্র পাল্টেছে। ২০২৩ সালের শীর্ষ বিন্দু থেকে ওই সূচক এখন ৬ শতাংশ কমে গেছে। লাফিত রথচাইল্ড ও মারগোর মতো বোর্দো ওয়াইনের দাম কমেছে ২০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিগত জেট ও বিলাসবহুল ইয়টের দাম কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। ব্যবহৃত রোলেক্সের বাজার আগের চেয়ে ৩০ শতাংশ ছোট। শিল্পকর্ম বিক্রির বাজারও মন্দায়।

স্যাভিলসের হিসাবে, লন্ডন ও প্যারিসে বিলাসবহুল আবাসনের দাম কমছে। সানফ্রান্সিসকোর ‘বিলিয়নিয়ার্স রো’ এলাকায় দুই বছর আগে যেটি ৩ কোটি ২০ লাখ ডলারে তোলা হয়েছিল বিক্রির জন্য, এখন সেটির দাম নেমে এসেছে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলারে।

ফোর্বসের হিসাব বলছে, বিশ্বে এখন বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি—গত বছরের তুলনায় ২০০ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে ধনীতম শূন্য দশমিক ১ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের ১৪ শতাংশ পারিবারিক সম্পদ, যা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এমনকি মার্ক জান্ডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের পর থেকে ধনীতম ৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষের খরচ বেড়েছে।

তাহলে দাম কমছে কেন? কারণ বিলাসপণ্যের অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে। থরস্টিন ভেবলেনের মতে, বিলাসিতা টিকে থাকে দুর্লভতা ও প্রতিযোগিতার ওপর। কোনো জিনিস তখনই বিলাসবহুল হয়, যখন তা অন্যদের জন্য অপ্রাপ্য হয়। কিন্তু আজ ওই দুই বিষয়ই বদলে গেছে।

বিশ্বের বহু দেশে উৎকৃষ্ট ওয়াইন তৈরি হচ্ছে। ল্যাবের তৈরি হীরার সঙ্গে প্রকৃত হীরার পার্থক্য খুঁজে পাওয়া দায়। পুরোনো পণ্যের অনলাইন বাজারে সামান্য অর্থে কিটন জ্যাকেট বা ব্যক্তিগত জেটও ভাড়া নেওয়া যায়। শিল্পকর্মও ভাগাভাগি মালিকানায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে এসব জিনিস আর ‘দুর্লভ’ নয়, তাই ‘বিলাসবহুল’ও মনে হয় না।

ধনীদের ব্যয় এখন পণ্য থেকে সরে অভিজ্ঞতার দিকে। দ্য ইকোনমিস্ট তৈরি করেছে ‘আল্ট্রা-লাক্সারি সার্ভিস ইনডেক্স’—যেখানে সেরা রেস্তোরাঁয় খাবার, সুপার বোলের টিকিট, বিরল ইভেন্টের প্রবেশাধিকারসহ নানা অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯ সালের পর থেকে এই সূচক বেড়েছে ৯০ শতাংশ। ২০২৩ সালের পর পণ্যের দাম কমলেও এই সূচক আরও বেড়েছে।

এর কারণ দুর্লভতা ও সীমিত সুযোগ। যেমন—প্যারিসের হোটেল লে ব্রিস্টল। ২০০টির কম কক্ষযুক্ত এই হোটেলের ছাদ থেকে দেখা যায় আইফেল টাওয়ার। সেখানে এখন এক রাত থাকার খরচ ২০১৯ সালের দ্বিগুণ।

যুক্তরাষ্ট্রে গৃহকর্মীর বেতন ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ফ্লোরিডার পাম বিচে বছরে দেড় লাখ ডলার আয় করছেন গৃহকর্মীরা।

উইম্বলডনের সেন্টার কোর্টে এক দিনের অভিজ্ঞতা বিক্রি করা যায় না। ২০১৬ সালে যার সদস্যপদ ছিল ৫০ হাজার পাউন্ড, এখন তার দাম ১ লাখ পাউন্ডের বেশি। সুপার বোল, মেট গালা, এনবিএ প্লে–অফ—সব জায়গায় অংশগ্রহণের খরচ দ্বিগুণ।

সানফ্রান্সিসকোর তিন তারকা রেস্তোরাঁ বেনু—সেখানে ২০১৫ সালের তুলনায় খাবারের দাম বেড়েছে ৭৮ শতাংশ। এক বেলার খরচ এখন ৫০০ ডলারের বেশি। কিন্তু সেখানে খাওয়ার অর্থ কেবল খাবার নয়—সেটি একান্ত উপস্থিতির আনন্দ।

নিউইয়র্ক ও প্যারিস ফ্যাশন উইক, এক্সক্লুসিভ ফান্ডরেইজার বা এনবিএ প্লে–অফে যাওয়া এখন শুধু ব্যয়ে নয়, গর্বের বিষয়ে। আপনি ছিলেন, অন্যরা ছিল না—এটাই এখন বিলাসিতা।

আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালের পুনর্বিক্রয়মূল্য কত হবে, কেউ বলতে পারে না। কিন্তু যে মুহূর্তে আপনি এমবাপ্পে আর ইয়ামালকে সরাসরি মাঠে দেখবেন, তখন এক বোতল শ্যাতো দ’ইকেমও তার সমান আনন্দ দেবে না।

বিলাসিতার মানে বদলে গেছে—পণ্যে নয়, অভিজ্ঞতায় এখন তার আসল আসন।