
প্রতিবেদক: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় ১১ মাস পার হয়েছে। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে নতুন অর্থবছর ২০২৫-২৬। আগের সরকারের সময় অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নিম্নমুখী হয়ে পড়ে। টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থেকেও সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর অর্থনীতিতে কিছু কাঠামোগত সংস্কার ও ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
এই পরিবর্তনের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। ব্যাংক খাতের সংকট কিছুটা হালকা হয়েছে এবং ডলারের বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। যদিও রপ্তানি আয় বড় আকারে না বাড়লেও তা সন্তোষজনক পর্যায়ে ছিল। প্রবাসী আয়ের প্রবাহও গত এক বছরে ভালো ছিল, যা অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে।
তবে অর্থনীতির কিছু সূচকে উন্নতি হলেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রত্যাশিত স্বস্তি আসেনি। মূল কারণ হলো, মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো প্রশমিত হয়নি। কিছুটা কমলেও মূল্যস্ফীতির প্রভাব সাধারণ মানুষের উপর তীব্র রয়েছে। একইসঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ অনেকটা স্থবির অবস্থায় রয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ আশানুরূপ বাড়েনি, বরং দারিদ্র্যসীমার নিচে নতুন মানুষ যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, রিজার্ভের বর্তমান চিত্র দেখে মনে হতে পারে এটি ভালো আছে, কিন্তু বাস্তবে এটি বিদেশি ঋণ প্রবাহ এবং কম আমদানি ব্যয়ের কারণে বেড়েছে। তাই এটিকে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা হিসেবে দেখা যাবে না।
নতুন অর্থবছরে সরকারের সামনে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে—মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মোকাবিলা। এর বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জও অপেক্ষা করছে। ৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। যদি কোনো সমঝোতায় না পৌঁছানো যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
রাজনৈতিক দিক থেকেও অর্থনীতি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। কারণ, সামনে জাতীয় নির্বাচন। অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচনের বছরগুলোতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে যায় এবং নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণে বিনিয়োগকারীরা সাবধানী হয়ে ওঠেন। এই অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকে আরও থমকে দিতে পারে।
তবে কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন—রিজার্ভ পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল। আইএমএফ-এর বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভের হিসাব ২৬ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, আর মোট রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি জুনের শেষ সপ্তাহে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ এসেছে, যা রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করেছে।
ডলারের দামও এখন তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। এটি আমদানি খরচ কমিয়ে অর্থনীতিকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে।
তবে বাস্তব চিত্র বলছে, নিত্যপণ্যের দাম গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে ঊর্ধ্বমুখী। এটি ১৯৮৬ সালের পর এত দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতির সর্বোচ্চ উদাহরণ। গড় মূল্যস্ফীতি বর্তমানে প্রায় ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ, যেখানে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি গত বছর জুলাইয়ে পৌঁছায় ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে। মজুরি না বাড়ায় সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা করছে, প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে অতিদারিদ্র্যের কাতারে পড়তে পারেন।
রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও তেমন আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি নেই। বিদায়ী অর্থবছরে এনবিআর ৩ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা আদায় করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে কিছু বেশি হলেও আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছায়নি। বিনিয়োগেও স্থবিরতা বিরাজ করছে। গত এক দশক ধরেই দেশি–বিদেশি বিনিয়োগে বড় কোনো অগ্রগতি নেই। নীতির অস্থিরতা, জটিল অনুমোদন প্রক্রিয়া, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট—এসব বাধা বিনিয়োগ বাড়ানোর পথে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে আছে।
সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে আংশিক অগ্রগতি থাকলেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান। নতুন অর্থবছরে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে সরকারকে অবশ্যই স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগ স্থবিরতা দূর করতে হবে এবং রাজস্ব কাঠামোয় দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে হবে।