নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অতিরিক্ত চাপ, পরোক্ষ করের বোঝা

অনলাইন ডেক্স: দেশের কর ব্যবস্থার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে, যা সকল শ্রেণির মানুষকে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং কেনাকাটার মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। এসব কর মূল্য সংযোজন কর, আমদানি শুল্ক, স্থানীয় পর্যায়ে শুল্ক ও রপ্তানি শুল্কের মাধ্যমে আদায় করা হয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মোট রাজস্বের ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ এক লাখ চার হাজার ২৬১ কোটি টাকা পরোক্ষ কর থেকে এসেছে, যেখানে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ ৫২ হাজার ১৮৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বাংলাদেশে কর কাঠামো দীর্ঘদিন ধরেই একই রকম রয়েছে, সামান্য কিছু পরিবর্তন হলেও পরোক্ষ করের হার বরাবরই বেশি।

২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করের হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যেখানে পরোক্ষ কর ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশের মধ্যে অবস্থান করছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পরোক্ষ কর সাধারণ মানুষের ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি করে এবং আয় বৈষম্য বাড়ায়।

এ কারণে প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে পরোক্ষ কর কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী। তিনি বলেন, দেশে অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা চাকরিজীবীদের তুলনায় কম কর দেন বা করই দেন না। এদের করের আওতায় আনতে হবে এবং ধাপে ধাপে পরোক্ষ কর কমাতে হবে।

কর বৃদ্ধি ও কর প্রশাসন সহজ করতে এনবিআর টিআইএন নম্বরধারীদের আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে দেশে এক কোটি ২০ লাখ টিআইএন নম্বরধারীর মধ্যে মাত্র ৪০ লাখ ব্যক্তি আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। যদি বাকি ৮০ লাখ করদাতাকে রিটার্নের আওতায় আনা যায়, তবে কমপক্ষে ২০ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর বাড়বে।

এনবিআর কর প্রদানে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো ও অনলাইন রিটার্ন দাখিল সহজ করার পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে। তবে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যানের মতে, কার্যকর আইন প্রয়োগের অভাব, বিদেশে অর্থপাচার রোধে অনীহা, দক্ষতার অভাব এবং জনগণের প্রতি বিশ্বাসযোগ্য আচরণ কর আদায়ের প্রধান বাধা। ফলে প্রত্যক্ষ করের হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছাতে পারছে না।

রাজস্ব আদায়ে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় দেওয়া হয়, যা গত সরকারের সময়ে প্রায় দুই যুগ ধরে প্রকট ছিল। কর্মকর্তারা বলেন, যদি মানুষ মনে করে যে কর পরিশোধের ফলে দেশের উন্নয়ন হচ্ছে না, অথবা কিছু পাচারকারী বিদেশে গাড়ি-বাড়ি কিনছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তাহলে মানুষ কর দিতে আগ্রহী হবে না। এনবিআর যে উদ্যোগগুলোর কথা বলছে, সেগুলো বাস্তবতা থেকে দূরে; প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ এবং আইনের সঠিক প্রয়োগের প্রয়োজন।

বাংলাদেশের পরোক্ষ করের হার নজিরবিহীন, যেখানে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অধিকাংশ রাজস্ব আদায় করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রত্যক্ষ করের হার বেশি, যেখানে ধনীদের ওপর চাপ বেড়ে যায়। অর্থনীতিবিদরা বলেন, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর ‘ইক্যুইটি প্রিন্সিপাল’ অনুসরণ করা উচিত; যার আয় বেশি, তার করও বেশি হওয়া উচিত। বাংলাদেশে পরিস্থিতি উল্টো, যেখানে দুই-তৃতীয়াংশ পরোক্ষ কর সাধারণ মানুষের থেকে আদায় হয়। উদাহরণস্বরূপ, রুটির ওপরে ভ্যাট দেওয়ার ফলে গরিব ও ধনী মানুষ একই দামে রুটি কিনে; এটি সমতার বিপরীতে।

ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কের মতো উন্নত দেশে প্রত্যক্ষ করের হার ৬০ শতাংশ, যেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মান কম, তাই মানুষকে বেসরকারি খাতে অতিরিক্ত খরচ করতে হয়। এই অবস্থান একটি অসন্তোষজনক নীতি এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর।