
প্রতিবেদক: ঢাকার কেরানীগঞ্জে ২০১৩ সালে ১৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) কার্যকরভাবে ব্যবহার না হলেও, এবার মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়ায় নতুন করে আরও বড় পরিসরে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ‘আন্তর্জাতিক মানের’ এই বন্দরের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫৬ কোটি টাকা।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, মুন্সিগঞ্জ–নারায়ণগঞ্জ শিল্পবেল্টের বিকাশ ও নদীভিত্তিক পণ্য পরিবহন সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে অবকাঠামোবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এ প্রকল্প নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন—তাঁদের আশঙ্কা, পানগাঁওয়ের মতই এই প্রকল্পও পরিণত হতে পারে ‘অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগে’।
২০০৫ সালে শুরু হয়ে ২০১২ সালে শেষ হওয়া পানগাঁও আইসিটি প্রকল্পে বছরে এক লাখ ১৬ হাজার কনটেইনার (টিইইউ) হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা থাকলেও, ২০২৩ সালে হ্যান্ডলিং হয়েছে মাত্র ২,৮৭৫ ইউনিট।
পরিবহন খরচ বেশি, পণ্য খালাসে দীর্ঘ সময়, এবং ব্যবসায়ীদের আগ্রহের অভাবকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ এই টার্মিনালের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর চাপ কমিয়ে ঢাকার শিল্পাঞ্চলে আমদানি-রপ্তানির জন্য বিকল্প পথ গড়ে তোলা।
মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়ায় ২৯ দশমিক ১৩ একর জমিতে গড়ে উঠবে নতুন কনটেইনার বন্দর। প্রস্তাবিত বন্দরে ২১৫ মিটার দীর্ঘ জেটি, ৩২ হাজার বর্গমিটার স্ট্যাক ইয়ার্ড, ৪ হাজার ৩০০ বর্গমিটার লোডিং-আনলোডিং এরিয়া থাকবে।
এখানে একসঙ্গে দুটি ১০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ ভেড়ানো যাবে এবং বছরে হ্যান্ডলিং করা যাবে ২ লাখ ৪ হাজার কনটেইনার। নির্মাণ শেষ হলে বছরে প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় এবং ৩১ লাখ টাকা রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হবে বলে জানানো হয়েছে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, “ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট থাকার পরও পানগাঁও ব্যর্থ হয়েছে। শিমুলিয়ায় যেহেতু শিল্প-কারখানা হাতে গোনা, তাই সেখানে নতুন বন্দরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “নতুন প্রকল্পের আগে ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করে তার সমাধান করা উচিত। পানগাঁওয়ের সমস্যাগুলো দূর করেই সেখানে পুনরায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে।”
নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর মতে, শিমুলিয়া প্রকল্প অনেক আগের পরিকল্পনার অংশ, এবং এই অঞ্চল ঘিরে পর্যটন ও বাণিজ্য—দুটোরই সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, “পানগাঁওয়ের মতো একটি প্রকল্প ব্যর্থ মানেই অন্য প্রকল্প ব্যর্থ হবে—এটা ঠিক নয়। মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে অনেক শিল্প-কারখানা রয়েছে। শিমুলিয়ার সঙ্গে এসব এলাকার ভালো সড়ক ও রেল সংযোগ রয়েছে, যা বন্দরের কার্যকারিতা বাড়াবে।”
তিনি আরও জানান, পানগাঁওয়ের ভাড়ানীতির কারণে টার্মিনালটি জনপ্রিয়তা পায়নি এবং ভবিষ্যতে সেখানে আন্তর্জাতিক অপারেটরের মাধ্যমে কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ব্যবহারহীন পানগাঁও বন্দর একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়া বড় প্রকল্প টেকসই হয় না। শিমুলিয়ায় নতুন করে বিশাল বিনিয়োগ করতে হলে, এর বাস্তবতাভিত্তিক সম্ভাব্যতা যাচাই ও অতীত অভিজ্ঞতার থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি। অন্যথায় সরকারি অর্থ খরচ করে আরেকটি ব্যর্থতার গল্প তৈরি হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার।