পিপিপি প্রকল্পে বিদেশির দাপট, দেশীয় বিনিয়োগে অনীহা

প্রতিবেদক: বিশ্বজুড়ে অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) পদ্ধতি জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে এ মডেল এখনো বেসরকারি খাতকে তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি। এ পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটি প্রকল্প আলোর মুখ দেখলেও, সেগুলোর বেশির ভাগই সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) পর্যায়ে সিদ্ধান্তে বাস্তবায়িত। প্রকৃত অর্থে পিপিপির যে অভিজ্ঞতা, তা থেকে এখনো বঞ্চিত বাংলাদেশ। যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেগুলোর বেসরকারি অংশীদারও প্রায় সবাই বিদেশি।

পিপিপি একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকেন্দ্রিক মডেল। সরকার বলছে, দেশীয় বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আগ্রহী নয়। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, সরকারই বাধা হয়ে দাঁড়ায়—কারণ, পিপিপির জন্য প্রয়োজনীয় নীতি বা কাঠামোগত সহায়তা যথাযথভাবে নিশ্চিত করা হয়নি।

এই বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে পিপিপি খাতে ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন, যা আগের বছরের ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার তুলনায় বেশি। বাজেট ঘোষণার সময় তিনি বলেন, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এর অংশ হিসেবে চালু করা হয়েছে ওয়ান–স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) পোর্টাল, যেখানে ৪৩টি সংস্থার ১৩৪টি সেবা দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে ব্যবসা সহজীকরণে চালু হয়েছে ‘বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো’ (বিএসডব্লিউ), যার মাধ্যমে একটি প্ল্যাটফর্মে আবেদন গ্রহণ থেকে সেবা দেওয়া পর্যন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।

বৈদেশিক বিনিয়োগ সহজ করতে তৈরি করা হচ্ছে ‘ইনভেস্টমেন্ট পাইপলাইন’, যার মাধ্যমে প্রতিশ্রুত বিনিয়োগগুলোকে কার্যকর বিনিয়োগে রূপান্তরের সুযোগ বাড়বে।

২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পিপিপি কর্তৃপক্ষ গঠন করে। শুরুতে ৩৪টি ও পরে ৪০টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হলেও বর্তমানে ৮১টি প্রকল্প পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নের তালিকায় রয়েছে। এদের মধ্যে ২০টি প্রকল্প শনাক্তকরণ পর্যায়ে, ২৯টি উন্নয়ন পর্যায়ে, ১৪টি দরপত্র ডাকার পর্যায়ে ও ১৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, মুনাফার সুযোগ না থাকলে বেসরকারি খাত পিপিপিতে আসবে না—এটাই স্বাভাবিক। অথচ দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগ সীমিত। পুঁজিবাজারে গ্রিন ফিল্ড কোম্পানিকে আসতে দেওয়া হয় না, ব্যাংক ঋণও সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জন্য মেলে। এছাড়া পিপিপির পর্ষদে বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার অন্যতম কারণ।

পিপিপি কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র মো. আলী আজম আল আজাদ জানান, দেশে পিপিপির মাধ্যমে চিকিৎসা ও অবকাঠামো খাতে ভালো সাড়া মিলছে। তবে মডেলটি নতুন হওয়ায় গতি কিছুটা কম। নীতিনির্ধারকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে গতি বাড়াতে সহায়ক হবে। যদিও দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ এখনো কম, ভবিষ্যতে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়বে বলেও তিনি আশাবাদী।

২০০৯ সালে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পিপিপি ধারণা সামনে আনেন। তৎকালীন মহাজোট সরকার ‘নব উদ্যোগ বিনিয়োগ প্রয়াস’ নামে ২০০৯–১০ অর্থবছরের বাজেটে পিপিপির জন্য ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে। দেশে অবকাঠামো উন্নয়নের বিপুল চাহিদা থাকার পরিপ্রেক্ষিতে, মুহিত পিপিপি আইন, নীতিমালা, বিধিমালাসহ প্রয়োজনীয় কাঠামো গড়ে তোলেন। প্রতি বছর তিন হাজার কোটি টাকার মতো বরাদ্দও রাখা হতো। তবে বেসরকারি খাতের অনাগ্রহের কারণে বরাদ্দের বড় অংশই অব্যবহৃত থাকত। কেবল সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কিছু অর্থ খরচ হতো।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে  ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শুরু হয়ে ২০১৬-১৭ এর মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো কাজ শেষ হয়নি। বেসরকারি অংশীদার প্রতিষ্ঠান হলো ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড।

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্পটি জিটুজি পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে। ব্যয় ২১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন করছে মিতসুবিশি, ফুজিতা ও স্যামসাংয়ের জয়েন্ট ভেঞ্চার।

হাতিরঝিল-রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা সড়ক উন্নয়ন চুক্তি হয়েছে চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানির (সিসিসিএল) সঙ্গে।

ঢাকা বাইপাস ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কের কাজ চলছে। অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলো হলো চীনের সিচুয়েন রোড অ্যান্ড ব্রিজ গ্রুপ, শামীম এন্টারপ্রাইজ এবং ইউডিই কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, পিপিপিতে সফলতা আনতে হলে ভালো প্রকল্প নিতে হবে, লাভজনকতা নিশ্চিত করতে হবে এবং নীতিগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। শুধু উচ্চাভিলাষী ঘোষণা দিয়ে বা বরাদ্দ দিয়ে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।