26 views 11 secs 0 comments

ফল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, দাম বাড়ায় ভোগান্তিতে ভোক্তা

অনলাইন ডেক্স: ফল মানুষের পুষ্টির জন্য অত্যন্ত জরুরি হলেও দিন দিন সাধারণ ভোক্তাদের জন্য তা বিলাসপণ্য হয়ে উঠছে। কারণ, সরকার গত কয়েক বছরে আমদানি করা তাজা ফলের ওপর ধারাবাহিকভাবে শুল্ক বৃদ্ধি করেছে। এর ফলে একদিকে ফলের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে আমদানি কমে গেছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে ফল আমদানিতে শুল্ক ছিল ৮৯.৩২%, যা বেড়ে বর্তমানে ১৩৬.২০% হয়েছে। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ১০০ টাকায় এক কেজি আপেল কিনলে আমদানি শেষে সরকারকে ১৩৬.২০ টাকা শুল্ক দিতে হচ্ছে। অন্যান্য খরচ (পরিবহন, ব্যাংকঋণের সুদ ইত্যাদি) যোগ করে পাইকারি বাজারে সেই আপেলের দাম দাঁড়াচ্ছে ২৫০ টাকা বা তার বেশি।

শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব

বছর বছর শুল্ক বৃদ্ধির ফলে আমদানি খরচ ব্যাপকভাবে বেড়েছে, যার ফলে—ফল আমদানি কমেছে,চাহিদা ও বিক্রি হ্রাস পেয়েছে।আমদানিকারকরা লোকসানে পড়েছেন
সাধারণ ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে ফল

উচ্চ শুল্ক ও ভ্যাটের প্রতিবাদে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন গত ৪ ও ৫ ফেব্রুয়ারি দেশের সব বন্দরে ফল খালাস বন্ধ রাখে।
তখন শুধু চট্টগ্রাম বন্দরে ১০০ কনটেইনার ফল জমে যায়
বেনাপোলসহ অন্যান্য স্থলবন্দরে ৭৫ ট্রাক ফল আটকে থাকে

পরে লোকসানের আশঙ্কায় আমদানিকারকরা ফল ডেলিভারি নিলেও আসন্ন রমজানে ফলের আমদানি নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

অতিরিক্ত সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) স্মারকলিপি দিয়েছে আমদানিকারক সমিতি। ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দাবি পূরণ না হলে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ফল খালাস বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এই সংকট নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

ফল আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, আমদানি করা আপেল, কমলা, আঙুর, নাশপাতি ও আনারসের ওপর শুল্ক-কর ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে—

২০২১-২২ অর্থবছরে মোট শুল্ক-কর ছিল ৮৯.৩২%
২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ১১৩.৮০%
চলতি অর্থবছরে দুই দফায় বাড়িয়ে ৯ জানুয়ারি ১৩৬.২০% করা হয়েছে

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নূরউদ্দীন আহমেদ জানান, গত এক বছরে এনবিআর তিন দফায় ৬০ থেকে ৭০ টাকা সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে। ফলে—

ফলের দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে
শিশুখাদ্য ও রোগীর পথ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ আপেল, আঙুর, কমলা বিলাসী পণ্যে পরিণত হচ্ছে
ব্যবসায়ীরা লাভের বদলে লোকসানে পড়ছেন

তিনি বলেন, আপেল-আঙুর-কমলা শিশুখাদ্য ও রোগীর পথ্য। এটি কীভাবে বিলাসী পণ্য হতে পারে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

সর্বশেষ কর বৃদ্ধির ফলে এখন আমদানি করা ফলের ওপর বসানো হচ্ছে—২৫% কাস্টমস ডিউটি, ৩০% সম্পূরক শুল্ক, ১৫% ভ্যাট,১০% অগ্রিম আয়কর,৫% অগ্রিম কর ও ২০% নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্ক

তবে এসব কর সরাসরি যোগ করলেই মোট শুল্ক-কর ১৩৬.২০% হয় না। কারণ কিছু শুল্ক—কাস্টমস ডিউটি, নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর—প্রথমে আমদানি করা ফলের মূল্যায়িত মূল্যের ওপর বসানো হয়। এরপর সেই নতুন মূল্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক হিসাব করা হয় এবং তার পরে চূড়ান্ত পরিমাণের ওপর বসানো হয় ভ্যাট ও অগ্রিম কর।

এই চক্রবৃদ্ধি কর পদ্ধতির কারণে সামগ্রিক শুল্কের বোঝা অনেক বেড়ে গেছে, যা আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং সাধারণ ভোক্তার নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে ফলের বাজার। তাই ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।

শুল্ক বৃদ্ধির কারণে দেশের ফল আমদানিতে ব্যাপক ধস নেমেছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত পাঁচ বছরে আমদানি কমেছে ৭৭,৪৭১ টন, যা ১৮.৫৬% হ্রাস।

চট্টগ্রাম বন্দর প্লান্ট কোয়ারেন্টিন স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী—

২০২৪-২৫ অর্থবছরের (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রথম ছয় মাসে আমদানি হয়েছে ১,৫৪,৪২৬ টন ফল
২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৩,৩৯,৮৯৪ টন
২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি ছিল ৩,৮৬,৪১০ টন
২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৪,৮০,২১৩ টন
২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি ছিল ৪,৬৫,৩২২ টন
২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি ছিল ৪,১৭,৩৬৫ টন

বাংলাদেশ বিশ্বের ২২টি দেশ থেকে ৩৮ ধরনের ফল আমদানি করে, যার মধ্যে ৯৫% আপেল, মাল্টা, কমলা, আঙুর ও আনার। বাকি ৫% অন্যান্য ফলের মধ্যে রয়েছে নাশপাতি, কিউই, অ্যাভোকাডো, রাম্বুটান ইত্যাদি।

শুল্ক বৃদ্ধিতে আমদানিকারকদের লোকসান

ব্যবসায়ীরা জানান, অতিরিক্ত শুল্কের ফলে আমদানিকৃত ফলের চাহিদা কমেছে, ফলে অনেক ব্যবসায়ী বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়েছেন।

গত তিন বছরে চট্টগ্রামের ফলমন্ডি থেকে অন্তত ৫০ জন আমদানিকারক দেউলিয়া হয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।

ফলের বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি

শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবে বাজারে ফলের দাম হু হু করে বেড়েছে।

রয়েল গালা আপেল – এক সপ্তাহে ২৬০-২৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৭০-৩৮০ টাকা ।সবুজ আপেল – ২৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৭০ টাকা।কমলা – ১৮০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫০ টাকা। নাশপাতি – ২৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৩০ টাকা।আঙুর (গ্রিন) – ২৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৩২০ টাকা।ডালিম – ৩৫০-৪২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা কেজিতে ৭৫ টাকা বেড়েছে

চট্টগ্রামের আমদানিকারক জিন্নাত আলী বলেন, “শুল্ক বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায়ীরা আমদানিকৃত ফল খালাস নিচ্ছেন না, কারণ বর্তমান বাজারদরে বিক্রি করলে নিশ্চিত লোকসান হবে। অনেকেই দাম বৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করছেন।”

চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির প্রচার সম্পাদক জুনায়েদুল হক বলেন, “করোনা ও ডলার সংকটের অজুহাতে সরকার কয়েক দফা শুল্ক-কর বাড়িয়েছে। আগে যে ব্যবসায়ী মাসে ১২ কনটেইনার ফল আমদানি করতেন, এখন তিনি সর্বোচ্চ ২-৩ কনটেইনার আমদানি করছেন। ফলে বাজারে আমদানিকৃত ফলের সংকট তৈরি হয়েছে, যা রমজানে আরও বাড়বে।”

ফল আমদানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা, অন্যথায় রমজানে বাজার আরও চাপে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।