বন্ড সুবিধার অপব্যবহারে শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি

In বন্দর
March 20, 2025

প্রতিবেদক: চট্টগ্রামের টেরিবাজারে জাহাজ থেকে খালাস হওয়া বন্ড সুবিধার কাঁচামাল নির্ধারিত বন্ডেড ওয়্যারহাউসে না গিয়ে সরাসরি ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন মার্কেটে পৌঁছাচ্ছে, যা সরকারের রাজস্ব ফাঁকির অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

বন্ডেড সুবিধার কাঁচামাল খোলাবাজারে পাচার

গোয়েন্দা অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাপড়, সুতা ও অন্যান্য সামগ্রী চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রাকে করে রাতের আঁধারে নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় খালাস করা হয়। এছাড়া, ঢাকার চিটাগং রোডের আশপাশের কিছু বাড়িকে অস্থায়ী গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব গোপন গোডাউন থেকে সুবিধামতো সময়ে রাজধানীর ইসলামপুর ও সদরঘাটের বিভিন্ন মার্কেটে বন্ড সুবিধার পণ্য সরবরাহ করা হয়।

এভাবেই অসাধু ব্যবসায়ীরা বন্ডেড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে, যা সরকারের শত শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য

সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) এই বিশেষ প্রতিবেদন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করেছে।

এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, বন্ড সুবিধায় আমদানি করা পণ্যের তালিকায় রয়েছে— নিট ফেব্রিকস, ওভেন ফেব্রিকস, ডেনিম ফেব্রিকস, মেস ফেব্রিকস,কটন, পলিয়েস্টার, নাইলন, ভলকানাইজড রাবার।প্রিন্টিং ইঙ্ক, সিনথেটিক অর্গানিক ডাইস, সালফার ডাইস, বেস কালারকাগজ, ডুপ্লেক্স বোর্ড, পলি প্রোপাইলিন, গামটেপ, আডহেসিভ টেপ, টিস্যু পেপার, আর্টকার্ড, কার্ড বোর্ড।

অ্যামিনো সিলিকন অয়েল, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কস্টিক সোডা, ফিনিশিং এজেন্ট, অ্যাসিটিক অ্যাসিড।ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট, সোডিয়াম সালফেট, ইলাস্টিক, হ্যাঙ্গার, জিপার, বাটন, পেডিং ইত্যাদি

বন্দর থেকে সরাসরি খোলাবাজারে সরবরাহ

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারত ও চীন থেকে বন্ডেড সুবিধায় আমদানি করা পণ্য প্রথমে চট্টগ্রামের টেরিবাজারে জাহাজ থেকে খালাস করা হয়। এসব পণ্য ওয়্যারহাউসে না নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মার্কেটসমূহে পাঠানো হয়।

নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডের আশপাশে আগে থেকেই ভাড়া করা বাড়িগুলোতে এসব পণ্য জমা রাখা হয়।

পরবর্তীতে ভ্যানযোগে ঢাকায় পাঠানো হয়, বিশেষ করে রাত ১২টার পর এসব পণ্য ইসলামপুর ও সদরঘাটের বিভিন্ন মার্কেটে পৌঁছে যায়।

ইসলামপুরের নূর ম্যানশন, সাউথ প্লাজা, গুলশান আরা সিটি, মনসুর ক্যাসেল, কে হাবিবুল্লাহ মার্কেট ও ইসলাম প্লাজা অন্যতম গন্তব্য।

গার্মেন্টস কাঁচামাল আমদানিকারকরা বেশি পরিমাণ ‘ওয়েস্টেজ’ দেখিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কাপড় আমদানি করে এবং তা অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন।

উদাহরণ হিসেবে,একটি শার্ট তৈরিতে ১.৭৫ গজ কাপড় প্রয়োজন হলেও ব্যবসায়ীরা ৩০% ওয়েস্টেজ দেখিয়ে ২.৭৫ গজ কাপড় আমদানি করেন।

ফলে, বন্ডেড সুবিধায় আমদানি করা অতিরিক্ত কাপড় খোলাবাজারে বিক্রির সুযোগ তৈরি হয়।

এছাড়া, বেশিরভাগ গার্মেন্টস আমদানিকারকরা স্যাম্পল পরিবর্তন করে বেশি দামের কাপড় এনে অসাধু উপায়ে মুনাফা করেন।

রাজস্ব ফাঁকির দায় কার

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এনবিআরের অনেক কর্মকর্তাই আমদানিকৃত কাপড়ের সঙ্গে স্যাম্পল যথাযথভাবে মিলিয়ে পণ্য খালাস করেন না। কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অসাধু আমদানিকারকরা এসব পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করছে, যা অর্থনীতিতে কোনো ইতিবাচক অবদান রাখে না।

এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এই রাজস্ব ফাঁকি ঠেকাতে কড়া নজরদারি ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বন্ড সুবিধার অপব্যবহার এবং শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অতিরিক্ত পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করার ঘটনা বেড়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, কিছু প্রতিষ্ঠান ওজনে কারচুপি, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এলসিতে উল্লেখ করা পরিমাণের চেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে। এর মাধ্যমে অতিরিক্ত পণ্যের মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাচার করা হচ্ছে।

এছাড়া, পণ্যের প্রাপ্যতা বা ইউডি ও ইউপি সংশোধন করে, কিছু প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানি করে রপ্তানির জন্য নির্ধারিত পোশাক তৈরি পর পর, অবশিষ্ট কাপড়, সুতাসহ অন্যান্য পণ্য অবৈধভাবে বিক্রি করে।

বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি করা কাঁচামাল দ্বারা উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব সুরক্ষিত হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে বন্ডের নিরীক্ষা বিভাগ প্রতিবছর নিরীক্ষা করে। তবে, সঠিকভাবে নিরীক্ষা না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুতা আমদানিতে ওয়েস্টেজ বেশি দেখানো এবং কাস্টমসের সহায়তায় সুতার গ্রেড পরিবর্তন করার মাধ্যমে অতিরিক্ত সুতা আমদানি করা হয়। এর ফলে সুতা ৬০-৭০% নরসিংদী, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি করা হয়। কম মূল্যের সুতার ঘোষণা দিয়ে দামি সুতা আমদানি করার কারণে সুতার অতিরিক্ত মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাঠানো হয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের অধিকাংশ গার্মেন্টস মালিক চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত। কিছু গার্মেন্টস মালিক ২০-২৫টি মেশিন বসিয়ে ভুয়া উৎপাদন দেখিয়ে বন্ড সুবিধার আওতায় কাপড়, সুতা ও অন্যান্য সামগ্রী আমদানি করে এবং তা খোলাবাজারে বিক্রি করে থাকে।

এছাড়া, গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারকদের একটি অংশ প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানি করে, এবং তা অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়।

গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্ড কমিশনারেটের কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় অসাধু রপ্তানিকারকরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাঁচামাল দেখিয়ে এবং বন্ধ কারখানায় রপ্তানির অনুমোদন দেখিয়ে বন্ড লাইসেন্স নিয়ে থাকে। এর ফলে গার্মেন্টস পণ্য ও চোরাচালান পোশাক খোলাবাজারে বিক্রি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাপড় ও সুতা খোলাবাজারে বিক্রি বন্ধে প্রতিবেদনে চারটি সুপারিশ করা হয়েছে ।

অটোমেশন সফটওয়্যার চালু করা বন্ড লাইসেন্সের অধীনে আমদানি করা কাঁচামাল এবং রপ্তানি সম্পর্কিত তথ্য পর্যবেক্ষণ করার জন্য অটোমেশন সফটওয়্যার চালু করা।

ওয়ারহাউস পরিদর্শন ও নিরীক্ষা বন্ড লাইসেন্সধারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ারহাউস আকস্মিক পরিদর্শন এবং তিন মাস অন্তর অন্তর নিরীক্ষা করা।

স্যাম্পল যাচাই ও গ্রেড পরিদর্শন এলসি খোলার সময় কাপড়ের স্যাম্পল যাচাই করতে বাধ্য করা এবং অটোমেটেড মেশিনে গ্রেড যাচাই করার ব্যবস্থা রাখা।

কমিটি গঠন গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল নিরূপণের জন্য এনবিআর, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা।

প্রতিবেদনটি এই সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন হলে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার কমিয়ে সরকারের রাজস্ব সুরক্ষিত করা সম্ভব হবে বলে জানান।