বাংলাদেশের প্লাস্টিক শিল্পের পথপ্রদর্শক এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক

প্রতিবেদক: বাংলাদেশে প্লাস্টিক চেয়ারের প্রচলন শুরু হয় ১৯৮৯ সালে, যখন এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক প্রথমবারের মতো এমএস ফ্রেমের আর্মলেস উইথ প্লাস্টিক বডি চেয়ার বাজারে নিয়ে আসে। এই পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে, যখন প্রতিষ্ঠাতা নুর মোহাম্মদ কাঠের ফোল্ডিং চেয়ারের দুর্ঘটনায় আহত এক প্রতিবেশিকে দেখে প্লাস্টিক চেয়ারের ধারণা পান।

পোশাক কারখানা গড়ার পরিকল্পনা থাকলেও, নুর মোহাম্মদ সিদ্ধান্ত নেন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করবেন। ১৯৮৪ সালে ১০টি মেশিন দিয়ে শুরু হয় এই উদ্যোগ। প্রথমদিকে ম্যানোলা, হারপিক, ডেটল-এর বোতল প্রস্তুত করলেও, ১৯৮৯ সালে প্রথম প্লাস্টিক চেয়ার বাজারে আনার মাধ্যমে এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক শিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এরপর ১৯৯০ সালে ফুল প্লাস্টিক চেয়ার নিয়ে আসে, যা এখনো জনপ্রিয়।

বর্তমানে এন মোহাম্মদ গ্রুপ প্রায় ১ হাজার ধরনের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করে এবং দেশের বাজারে ২০ শতাংশ প্লাস্টিক পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি জাপানে রপ্তানি করে।

উত্তরাধিকার ও সম্প্রসারণ

২০১২ সালে নুর মোহাম্মদের মৃত্যুর পর তার পরবর্তী প্রজন্ম প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও আরব আমিরাতে এন মোহাম্মদ গ্রুপের অধীনে ১০টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে—বাংলাদেশে ৮টি ও আমিরাতে ২টি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক কাজ করছে, যার মধ্যে আরব আমিরাতের ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে ১৩০ জন বাংলাদেশি কর্মরত।

প্রতিষ্ঠানটির মোট বিনিয়োগ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা এবং এসেট ভ্যালু ১ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ২৫০ কোটি টাকা।

নতুন প্রকল্প ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনা

এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক ২০১২ সালে দেশে প্রথমবারের মতো উড প্লাস্টিক কম্পোজিট ডোর (WPC Door) বাজারে নিয়ে আসে, যা এখনো বাজারের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে।

উৎপাদন সক্ষমতা-পিভিসি ও এইচডিপিই পাইপ ১৫ হাজার মেট্রিক টন।পিভিসি ফিটিং ১২ হাজার মেট্রিক টন।ডব্লিউপিসি ও পিভিসি ডোর ৯ হাজার মেট্রিক টন।ডব্লিউপিসি ও পিভিসি বোর্ড ৭ হাজার মেট্রিক টন।হাউজহোল্ড ও ফার্নিশিং ১০ হাজার মেট্রিক টন।ফ্লেক্সিবল প্যাকেজিং: ৭ হাজার ২০০ মেট্রিক টন

নতুন উদ্যোগ হিসেবে “বিল্ড বেস্ট বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস” নামে একটি আউটলেট চালু করতে যাচ্ছে এন মোহাম্মদ গ্রুপ, যেখানে একই ছাদের নিচে সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রী পাওয়া যাবে।

মিরসরাই  শিল্প নগরে ১০ একর জায়গায় ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে একটি প্লাস্টিক কারখানা গড়ে তোলা হবে, যা ২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং প্রতিমাসে ১০০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে।

এন মোহাম্মদ গ্রুপ শুধুমাত্র প্লাস্টিক শিল্পে অগ্রণী ভূমিকা রাখেনি, বরং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটি আরও নতুন পণ্য ও বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিল্পখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

অল্পবয়সেই সংগ্রাম শুরু 

ছোটবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়ে নুর মোহাম্মদ কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকলেও প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। শিশুকালেই জীবিকা নির্বাহের তাগিদে চট্টগ্রামের একে খান এলাকায় একটি মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপে কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ হেঁটে গ্রামের বাড়ি হাটহাজারীর নজুমিয়াহাট থেকে কর্মস্থলে যেতেন। তার সততা ও সৃজনশীলতায় ওয়ার্কশপের মালিক মুগ্ধ হন এবং একসময় তাকে পাকিস্তানের করাচিতে মেকানিক হিসেবে পাঠানোর সুপারিশ করেন।

পাকিস্তান ও দুবাইয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা

১৯৬৪ সালে মাত্র ২ টাকা পকেটে নিয়ে জাহাজে করে করাচি পৌঁছান নুর মোহাম্মদ। অল্প সময়ের মধ্যেই দক্ষতা ও নিষ্ঠার কারণে ওয়ার্কশপ পরিচালনার দায়িত্ব পান। ১৬ বছর বয়সেই তিনি মার্সিডিজ বেঞ্জসহ বিভিন্ন দামী গাড়ি মেরামতের কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

দুই বছর পর তিনি চলে যান দুবাই, যেখানে নিজের উদ্যোগে “নুর ইঞ্জিনিয়ারিং” নামে একটি গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করেন। তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লে দূর-দূরান্ত থেকে গ্রাহকরা আসতে থাকেন। তবে, দুবাই সরকার তার কারখানার জমি মসজিদ নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণ করলে তিনি ব্যবসা স্থানান্তর করেন শারজাহতে। সেখানেও প্রতিকূল পরিবেশে ১৬ জন বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়ে পুনরায় ওয়ার্কশপ চালু করেন এবং ধীরে ধীরে এটি একটি পরিচিত ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে ব্যবসায়িক যাত্রা

১৯৮০ সালে নুর মোহাম্মদ চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায় জমি কিনে “এন মোহাম্মদ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ” প্রতিষ্ঠা করেন। এই ওয়ার্কশপ চট্টগ্রাম বন্দর, বাণিজ্যিক জাহাজ ও রেলওয়ের ইঞ্জিন মেরামতের কাজ করত। এখান থেকেই বাংলাদেশের বাজারে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯৮৪ সালে কাঠের ফোল্ডিং চেয়ারের দুর্ঘটনা দেখে প্লাস্টিক চেয়ারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি। সেই চিন্তা থেকেই প্লাস্টিক শিল্পে প্রবেশ করেন এবং ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্লাস্টিক চেয়ার বাজারে আনেন।

এন মোহাম্মদ গ্রুপের বর্তমান অবস্থা

এন মোহাম্মদ গ্রুপ বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তারা প্রায় ১ হাজার ধরনের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করে, যার মধ্যে ২০ শতাংশ দেশের বাজারে সরবরাহ করা হয় এবং জাপানে রপ্তানি করা হয়।

বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সেক্রেটারি জেনারেল নারায়ণ চন্দ্র দে বলেন, “বাংলাদেশে প্লাস্টিক শিল্পের বাজার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার ৫ শতাংশই প্লাস্টিক চেয়ারের দখলে। দেশে প্রায় ৫ হাজার ১০০টি প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে, যার মধ্যে ৩০-৫০টি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। প্রায় ৪০০ প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিতে যুক্ত, যেখানে বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে প্লাস্টিক চেয়ারের অংশ ২ শতাংশ।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সম্প্রসারণ

এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল হক বলেন, আমার বাবা মধ্যপ্রাচ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ থেকে অর্জিত আয়ের টাকায় বাংলাদেশে প্লাস্টিক কারখানা গড়ে তুলেছেন। আমরা দ্বিতীয় প্রজন্ম তার স্বপ্নকে এগিয়ে নিচ্ছি এবং ভবিষ্যতে এন মোহাম্মদ গ্রুপের ব্যবসার পরিধি আরও বিস্তৃত করতে চাই।

তিনি আরও বলেন, আমরা সর্বদা কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটিকে গুরুত্ব দিয়েছি, যা আমাদের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। শীঘ্রই আমরা প্লাস্টিক ট্যাংক উৎপাদনে যাচ্ছি, যেখানে সর্বোচ্চ ১০ হাজার লিটার পানি ধারণক্ষমতার ট্যাংক তৈরি হবে।

এন মোহাম্মদ গ্রুপ ভবিষ্যতে আরও নতুন পণ্য, প্রযুক্তি ও বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্লাস্টিক শিল্পের মানচিত্রে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।

দেশের প্রতি নুর মোহাম্মদের ভালোবাসা

নুর মোহাম্মদের দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ ছিল গভীর। তার ছেলে মোহাম্মদ নজরুল হক বলেন, অনেকেই বিদেশ থেকে উপার্জিত অর্থ বিদেশেই বিনিয়োগ করেন, কিন্তু আমার বাবা সেই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে প্লাস্টিক কারখানা ও ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ গড়ে তুলেছেন।”শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অবদান রেখেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন স্থানে সভা আয়োজন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন এবং দেশে পাঠিয়েছেন। এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদান করে এবং রেমিট্যান্স ক্যাটাগরিতে সিআইপি ঘোষণা করে।

কর্মীদের প্রতি এন মোহাম্মদ গ্রুপের সংবেদনশীলতা

শুরু থেকেই এন মোহাম্মদ গ্রুপ তার কর্মীদের প্রতি সংবেদনশীল মনোভাব বজায় রেখেছে। বহু কর্মী টানা ৩০ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কর্মীদের কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে—রমজানে বিনামূল্যে ইফতার ও সেহরির ব্যবস্থা, প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় ফ্রি নাশতা,মাত্র ১০ টাকায় লাঞ্চ,ফ্রি আবাসনের ব্যবস্থা

করোনাকালীন সময়েও এন মোহাম্মদ গ্রুপ তাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছে। কোনো কর্মীর বেতন কাটা হয়নি, কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। আক্রান্ত শ্রমিকদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR) কার্যক্রমের আওতায় বোয়ালখালী উপজেলায় সড়কবাতি স্থাপন, বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা এবং করোনা মহামারির সময় হাসপাতালে সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

গ্যাস সংকট এন মোহাম্মদ গ্রুপের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে চাহিদা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান উৎপাদনের দ্বিগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেও গ্যাস সংযোগের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। নতুন কারখানায় গ্যাস সংযোগ নিশ্চিত হলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন পণ্য বাজারে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।

এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল হক বলেন, “এই সেক্টরে দক্ষ কর্মীর সংকট তৈরি হয়েছে। সরকার যদি ট্রেনিং সেন্টার ও কারিগরি শিক্ষা চালু করে, তাহলে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা সম্ভব হবে।”

সামনের দিনগুলোতে এন মোহাম্মদ গ্রুপ নতুন প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের শিল্পখাতে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চায়।