বাংলাদেশের ৩৭% শুল্ক বাড়ানোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সমঝোতার চেষ্টা

প্রতিবেদক: ৯ এপ্রিল ইস্টার্ন ডে-লাইট সময় ১২টা ১ মিনিট, বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত ১০টা ১ মিনিট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী দেশভিত্তিক বাড়তি শুল্ক কার্যকর হতে যাচ্ছে। এই সময় থেকে কার্যকর হওয়া নতুন শুল্কের আওতায় ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্কের পাশাপাশি ৯ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের পণ্যে বাড়তি শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়েছে।

যেমন, ধরা যাক, বাংলাদেশে তৈরি একটি পোশাকের ক্রয়মূল্য ১০ ডলার। ৫ এপ্রিলের আগে, নির্দিষ্ট এইচএস কোড অনুযায়ী ওই পোশাকের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক ছিল, যার ফলে শুল্কসহ দাম দাঁড়াতো ১১ ডলার ৫০ সেন্ট। তবে ৫ এপ্রিলের পর ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক যোগ হওয়ায় শুল্কের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ, ফলে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ ডলার ৫০ সেন্ট।

৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া দেশভিত্তিক শুল্ক বৃদ্ধির পর, বাংলাদেশের পণ্যে ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, ফলে মোট শুল্কহার দাঁড়াবে ৫২ শতাংশ। এই নতুন শুল্কের ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওই পোশাকটির ক্রয়মূল্য হবে ১৫ ডলার ২০ সেন্ট। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারক ও সাধারণ ক্রেতাদের ওপর বাড়তি অর্থের চাপ পড়বে।

এই বাড়তি চাপের ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ ক্রেতারা যদি শুল্ক বৃদ্ধির ফলে দাম বাড়ানোর চাপ নিতে না পারেন, তবে পোশাকের চাহিদা কমে যেতে পারে। আর যদি অন্য দেশের ওপর শুল্কহার বাংলাদেশের তুলনায় কম হয়, তবে আমদানিকারকরা সমমানের পণ্য ওই দেশ থেকে বেশি কিনে ক্রেতাদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এর ফলে, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি কমতে পারে।

তবে, প্রশ্ন উঠতে পারে, দেশভিত্তিক বাড়তি শুল্ক থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি না? উত্তর হলো, হ্যাঁ, সুযোগ রয়েছে। ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, “যদি কোনো বাণিজ্য অংশীদার আমাদের সঙ্গে অসহযোগিতামূলক বাণিজ্য চর্চা থেকে বের হওয়ার উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয় এবং আমাদের অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় পর্যাপ্ত সহযোগিতা করে, তাহলে আমি সে দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক কমাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।”

এই নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে, ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখছেন তার দেশের পণ্য আমদানিতে ‘বেশি শুল্ক আরোপ এবং অশুল্ক বাধা’। তিনি মনে করেন, এর ফলে তার দেশের বাণিজ্য ঘাটতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। গত বছর তা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। ট্রাম্পের লক্ষ্য হলো, অন্যান্য দেশগুলো যেন আমেরিকার পণ্য বেশি করে আমদানি করে, যাতে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যায়। তবে শুধু ঘাটতি কমালেই তিনি সন্তুষ্ট হবেন না; তার মতে, বাণিজ্যে ন্যায্য ভারসাম্য আসতে হবে, এমনকি “ব্রেক ইভেন” বা সমান সমান অবস্থায় আসতে হবে। তিনি জানিয়েছেন, যদি ন্যায্য ভারসাম্য না আসে, তাহলে তিনি শুল্কে ছাড় দিতে চান না।

এছাড়া, ট্রাম্প আলোচনার সুযোগও রেখেছেন। এর মাধ্যমে তিনি অন্য দেশগুলোর প্রতি একধরনের চাপ সৃষ্টি করেছেন, যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে সমতা বা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে এবং তার দেশের অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করে।

এভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন শুল্ক নীতি পণ্যের দাম বাড়াতে পারে, তবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য এখনও রেহাই পাওয়ার একটি সুযোগ রয়ে গেছে, যদি তারা যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মেনে বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য আনতে সক্ষম হয়।

বাংলাদেশসহ ৫০টির বেশি দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করতে চায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির পরিবর্তন ও বাড়তি শুল্ক সম্পর্কে। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি চিঠি দিয়েছেন, যেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পদক্ষেপে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশ আমদানি বাড়ানোর জন্য শুল্ক কমানোর পাশাপাশি এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করবে এবং অশুল্ক বাধা দূর করার জন্য কিছু চলমান ও পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তিনি আরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ এসব কার্যক্রম সম্পন্ন করবে।

এছাড়া, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখারও অনুরোধ জানিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। বাংলাদেশের মতো একই ধরনের অনুরোধ আরও কয়েকটি দেশও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জানিয়েছে।

চীনের ক্ষেত্রে বাদে, বাকি দেশগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আপাতত স্থগিত করতে যাচ্ছে—এমন খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্ধৃতি দিয়ে সিএনবিসি জানিয়েছে, এই খবরটি সঠিক নয়।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের দিক থেকে বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহার বা কমানোর যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, তা এই পরিস্থিতিকে সহজ করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তিনি আশঙ্কা করছেন যে, বেশি শুল্ক আরোপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেতে পারে।

মোস্তফা আবিদ খানের মতে, বাংলাদেশ প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যা করেছে, তা ঠিক আছে। এখন সমঝোতার পদক্ষেপগুলো এগিয়ে নিতে হবে। ৯ এপ্রিল হয়তো শুল্ক স্থগিত হবে না বা শুল্ক কমবে না, তবে আলোচনার সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে যেসব পণ্য বেশি আসে, তার শুল্কহার খুবই কম, যেমন—তুলা ও সয়াবিনের মতো পণ্যে কোনো শুল্ক নেই। ট্রাম্প প্রশাসনের মূল লক্ষ্য হলো বাণিজ্য ঘাটতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা, এবং তারা চান যে অন্য দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি আমদানি করুক।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশে বাণিজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ৮৪০ কোটি ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১ শতাংশ বেশি। অপরদিকে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে দেড় শতাংশ কম। এই হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬২০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি।

ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, আমেরিকার উৎপাদকরা বিদেশী বাজারে তাদের পণ্য রপ্তানির সময় শুল্কসহ নানা অশুল্ক বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব অশুল্ক বাধার মধ্যে রয়েছে—লাইসেন্সিং বিধিনিষেধ, কাস্টমস বিধিনিষেধ, বাণিজ্য সহজ না করা, মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে ঘাটতি, বিনিময় হারে অন্যায্য চর্চা ইত্যাদি।

অনেক দেশ তাদের শ্রমিকদের মজুরি কম রেখে এবং ভোগ কমিয়ে বিশ্ববাজারে কৃত্রিমভাবে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকছে। যারা এসব অন্যায্য চর্চা বন্ধ করবে, তাদের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন নমনীয় হতে পারে। ফলে, বাংলাদেশের উদ্যোগ এবং তাতে ট্রাম্প প্রশাসনের সন্তুষ্টির মাত্রার ওপর নির্ভর করবে, কতটুকু ছাড় পাওয়া যাবে বাড়তি শুল্ক থেকে।