বাংলাদেশে বৈশ্বিক শুকনা আমের বাজারে প্রবেশের সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন দুই কৃষি উদ্যোক্তা

প্রতিবেদক:কাঁচা আম শুকিয়ে ‘শুকনা আম’ হিসেবে বাজারজাত করে আলোচনায় এসেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুই কৃষি উদ্যোক্তা—মুনজের আলম ও ইসমাইল খান শামীম। অনেকেই ভাবতে পারেন, শুকনা আম তৈরি করা কতটা লাভজনক বা কঠিন! বাস্তবে, শুকনা আমের বৈশ্বিক বাজারের পরিমাণ প্রায় ২২৪ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় দাঁড়ায় ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ এই বিশাল বাজারে বাংলাদেশের উপস্থিতি নেই বললেই চলে।

প্রতি বছর দেশে ২৫ থেকে ২৬ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়, যার প্রায় ৪০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এই নষ্ট বা অব্যবহৃত আম থেকেই শুকনা আম বানিয়ে মূল্য সংযোজন করছেন উদ্যোক্তারা। তাঁরা মনে করেন, শুধু শুকনা আম থেকেই বাংলাদেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার বাজার দখল করতে পারে।

করপোরেট চাকরি ছেড়ে পাঁচ বছর আগে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা শুরু করেন মুনজের আলম। ‘বরেন্দ্র কৃষি উদ্যোগ’ ও ‘শুদ্ধ’ নামের প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হিসেবে এ বছর তিনি ৭০০ কেজি শুকনা আম তৈরি করেছেন। অনলাইনে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ টাকা দরে, আর আমের পাউডার বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকায়। তিনি জানান, উৎপাদিত প্রায় সব শুকনা আম ইতোমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। আগামী বছর তাঁর লক্ষ্য অন্তত ২০ মেট্রিক টন শুকনা আম উৎপাদন, যার বেশির ভাগ রপ্তানি হবে। কাঁঠাল ও পেয়ারা শুকিয়েও পণ্য তৈরি করেছেন তিনি, আর আগামী বছর কলা ও আনারস নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা আছে।

অন্যদিকে, ইসমাইল খান শামীম শুকনা আম তৈরি করতে থাইল্যান্ডে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রযুক্তিগত সহায়তা না পেয়ে দেশে ফিরে নিজ উদ্যোগে কাজ শুরু করেন। কাটিমন ও গোবিন্দভোগ দিয়ে চেষ্টা করলেও সফল হননি। পরে আশ্বিনা জাতের আম দিয়ে সফলতা পান। তিনি জানান, ৪০ বার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অবশেষে ভালো মানের শুকনা আম উৎপাদন করেছেন। এক মণ আম থেকে প্রায় ৪ কেজি শুকনা আম পাওয়া যায়। এ বছর তিনি ৩০০ কেজি শুকনা আম তৈরি করেছেন এবং সব বিক্রি হয়ে গেছে। আগামী বছর তাঁর লক্ষ্য ১৩ টন শুকনা আম উৎপাদন।

বিভিন্ন বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান—এক্সপার্ট মার্কেট রিসার্চ, কগনিটিভ মার্কেট রিসার্চ ও গ্র্যান্ডভিউ রিসার্চের হিসাবে, আমজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজারের আকার ২৫ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুকনা আমের বাজার ২৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। প্রতিবছর এই বাজার সাত শতাংশ হারে বাড়ছে, কিন্তু বাংলাদেশের কোনো অংশগ্রহণ নেই।

মুনজের আলম মনে করেন, শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের বাজারই প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার। আশপাশের জেলার আম প্রক্রিয়াজাত করা হলে এই বাজার দাঁড়াবে ২২ হাজার কোটি টাকায়। এতে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বর্তমানে দেশেই বছরে শতকোটি টাকার আমের পাউডার আমদানি করা হয়, যার বিকল্প তৈরি করছেন উদ্যোক্তারা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও রাজশাহীতেই দেশের বেশির ভাগ আম উৎপাদিত হয়, কিন্তু সরকারি পর্যায়ে এখনো কোনো প্রক্রিয়াজাত শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বেসরকারিভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ম্যাঙ্গো বার ও জুস তৈরি করলেও শুকনা আম শিল্প নেই। কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করেন, উদ্যোক্তারা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা বৃহৎ শিল্পে পরিণত করার জন্য সরকারি কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।

ইতোমধ্যে কৃষি অধিদপ্তরের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের মাধ্যমে এ বছর ২ হাজার মেট্রিক টনের বেশি আম রপ্তানি হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুর রহমান জানিয়েছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুটি প্রক্রিয়াজাত প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং কিছু পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রয়েছে। সফল হলে তা বাণিজ্যিক উৎপাদনে নেওয়া হবে।