
প্রতিবেদক: বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সবচেয়ে বড় সমস্যা বা ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন জাপানি বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রায় ৯৫% জাপানি কোম্পানি এই ঝুঁকিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, সস্তা শ্রম ও বাজারসুবিধার কারণে ৬১% জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী।
জেট্রোর জরিপ
জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কার্যরত ১৩,৭২৭টি জাপানি কোম্পানি এই জরিপে অংশ নেয়।
বাংলাদেশে কার্যরত ১৭৫টি জাপানি কোম্পানি জরিপে অংশ নেয়।জরিপটি ২০২৩ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিচালিত হয় এবং সম্প্রতি জেট্রোর ওয়েবসাইটে এর ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যবসা সম্প্রসারণে দ্বিতীয় পছন্দ
জাপানি কোম্পানিগুলোর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কোন দেশ তাদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
ভারতকে ৮০% জাপানি কোম্পানি প্রথম পছন্দ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।এরপরই রয়েছে বাংলাদেশ (৫৮%), যদিও আগের বছরের তুলনায় এই হার কিছুটা কমেছে।বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও লাওস।
জরিপে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের কোন দিকগুলো আকর্ষণীয়। জাপানি কোম্পানিগুলো পাঁচটি বড় সুবিধার কথা জানিয়েছে—সস্তা শ্রম ও বাজার সম্ভাবনা – ৬১.৩% । শ্রমিক ও কর্মচারীর সহজপ্রাপ্তি – ২৯.৩%,ভাষাগত সুবিধা – ২০%,করছাড় ও প্রণোদনা সুবিধা – ১৪.৭%,বিশেষায়িত জনশক্তি – ১৪.৭% ।
এছাড়া, সস্তা শ্রমের জন্য মিয়ানমার, লাওস ও শ্রীলঙ্কাকেও এগিয়ে রেখেছে জাপানি কোম্পানিগুলো।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কম্বোডিয়াকে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য বেশি পছন্দ করছেন জাপানি বিনিয়োগকারীরা।
এছাড়া, বাজার সুবিধার দিক থেকে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়া এগিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
জাপানি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে ব্যবসার ব্যাপারে আশাবাদী হলেও, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার অন্যতম প্রধান শর্ত। যদি এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠা যায়, তবে জাপানি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ আরও বাড়তে পারে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বড় পাঁচ ঝুঁকি
বাংলাদেশে কাজ করা জাপানি কোম্পানিগুলোর এক জরিপে উঠে এসেছে যে, দেশের ব্যবসা পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা। এছাড়া, সরকারের অস্পষ্ট নীতি ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুতের অবকাঠামোর ঘাটতি, আইনগত অস্পষ্টতা ও জটিলতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা—এই পাঁচটি কারণে বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রধান বাধা তৈরি হচ্ছে।
এ জরিপে অংশ নেয়া ৯৫ শতাংশ জাপানি কোম্পানি মনে করে, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ব্যবসায়িক পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। বিশেষ করে গত বছর আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর দেশে অস্থিতিশীলতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, যা ব্যবসায়ীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি উল্লেখযোগ্য যে, জরিপটি সেই সময়েই পরিচালিত হয়েছিল, যা জাপানি বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগের বিষয়টি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।
মুনাফা বৃদ্ধির পূর্বাভাস
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে বাংলাদেশে কাজ করা ৫০ শতাংশ জাপানি কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধি পেতে পারে। অন্যদিকে, ৪৩.৫ শতাংশ কোম্পানি চলতি বছর আয়-ব্যয়ের সমতা বজায় রাখবে এবং ৬.৫ শতাংশ কোম্পানির মুনাফা কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে, শ্রীলঙ্কায় কাজ করা জাপানি কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি মুনাফা করবে, এরপর পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইনস, ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে।
এছাড়া, ব্যবসায়িক আস্থাও আগের তুলনায় বেড়েছে। জরিপে অংশ নেয়া ৪৩.৫ শতাংশ কোম্পানি মনে করছে যে, বাংলাদেশে ব্যবসায়িক আস্থা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসায়িক আস্থা বৃদ্ধির দিক থেকে শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
ব্যবসা সম্প্রসারণের আগ্রহ
এই অঞ্চলের অধিকাংশ জাপানি কোম্পানি আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চায়। বিশেষত, ভারত এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে, এরপর বাংলাদেশ রয়েছে। উৎপাদন খাতে কাজ করা জাপানি কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, স্বাভাবিকভাবেই জাপানি বিনিয়োগকারীদের এমন উদ্বেগ প্রকাশ পাওয়া উচিত। গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বেড়ে গেছে এবং নতুন সরকারের বৈদেশিক নীতিতেও কিছু পরিবর্তন এসেছে, যা জাপানি স্বার্থের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তিনি আরও বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অবকাঠামো সংকট এবং দুর্নীতি প্রভৃতি কাঠামোগত সমস্যা আগে থেকেই বিদ্যমান, যা বিনিয়োগের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে, এর পরও বেশিরভাগ জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী, যা একটি ইতিবাচক দিক।
এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের ব্যবসা পরিবেশের উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ, তবে জাপানি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক আগ্রহ দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে আরো উজ্জ্বল করে তুলছে।